RSS

কুরবানীর ইতিহাস

কুরবানী : কুরবানী সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ হচ্ছে, ‘‘নিশ্চয়ই (হে নবী!) আমি আপনাকে (নিয়ামত পূর্ণ) কাওসার দান করেছি, অতএব, আপনি আপনার ‘রব’ এর সন্তুষ্টির জন্যে সালাত কায়েম করুণ ও তাঁর নামে কুরবানী করুন’’(সুরা আল কাওসার-১০৮/১-২)। রাসূল (স) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করবে না সে যেন ঈদগাহের কাছেও না আসে’ (আহমদ ও ইবনে মাযাহ)। হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (স) বলেছেন, কুরবানীর দিনে মানবসন্তানের কোন নেক আমলই আল্লাহ তায়ালার নিকট তত প্রিয় নয়, যত প্রিয় কুরবানী করা। কুরবানীর পশুর শিং, পশম ও ক্ষুর কিয়ামতের দিন (মানুষের নেক আমলনামায়) এনে দেয়া হবে। কুরবানীর পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়। সুতরাং তোমরা আনন্দচিত্তে কুরবানী করো’’ (তিরমিযী)।

কুরবানীর অর্থ : আমাদের সমাজে বাংলায় প্রচলিত কুরবানী শব্দের অর্থ হচ্ছে, নিকটবর্তী হওয়া বা সান্নিধ্য লাভ করা। আল কুরআনে সুরা আল মায়েদার ২৭ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে, ‘ইয ক্কাররাবা-ক্কুরবা-নান’ অর্থাৎ যখন তার দু‘জনে কুরবানী পেশ করলো বা পশু জবাই করলো, কিংবা জবাই করে ফেলে আসল। সুরা আল কাওসারে বলা হয়েছে, ‘ফাছাল্লি লিরাবিবকা ওয়ানহার’ অর্থাৎ অতএব, (হে নবী!) আপনার ‘রব’-এর স্মরণে সালাত আদায় করুণ ও তাঁর সন্তুষ্টির জন্যে কুরবানী করুণ’। এখানে ‘নাহার’ বলতে কুরবানী বোঝানো হয়েছে। আসলে ‘নাহার’ শব্দে আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, নহর, বিশেষ নিয়মে জবাই বা হত্যা করা কিংবা প্রিয় বস্তুকে জবাই বা ত্যাগ করা।

কুরবানীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : দুনিয়ায় মানব বসতির শুরুতেই কুরবানীর প্রচলন শুরু হয়েছে। পৃথিবীর প্রথম মানুষ আমাদের আদি পিতা ও নবী আদম (আ:) এর প্রথম সন্তান কাবিল ছিল আল্লাহ তায়ালা ও পিতা-মাতার অবাধ্য, নাস্তিক বা কাফের। কাবিলের ছোট ভাই, হযরত আদম (আ) এর দ্বিতীয় ছেলে হাবিল ছিল আল্লাহভক্ত ও মু‘মেন। সে সময় আল্লাহ তায়ালার হুকুমে জোড়া জোড়া সন্তান হতো। এক জন পুত্র ও এক জন কন্যা সন্তান। আল্লাহ তায়ালার বিধান মতো প্রথম জোড়ার পুত্রের সাথে দ্বিতীয় জোড়ার কন্যার বিয়ে বৈধ ছিল। কাবিল আল্লাহ তায়ালার বিধান মানতে রাজি ছিল না। সে চেয়ে ছিল তার জোড়ার সুন্দরী বোনকেই বিয়ে করবে। শেষ পর্যন্ত তাদের দু‘জনকে কুরবানী পেশ করার নির্দেশ দেয়া হলো। আর বলা হলো যার কুরবানী কবুল করা হবে সে-ই প্রথম জোড়ার সুন্দরী বড় বোন কে বিয়ে করবে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা হচ্ছে, ‘(হে নবী!) আপনি এদের কাছে আদমের দুই সন্তানের গল্পটি যথাযথভাবে শুনিয়ে দিন; গল্পটি ছিলো, যখনই তারা দু‘জনে আল্লাহর নামে কুরবানী পেশ করলো, তখন তাদের মধ্যে একজনের (হাবিলের) কাছ থেকে কুরবানী কবুল করা হলো, আর একজনের (কাবিলের) কাছ থেকে কুরবানী কিছুতেই কবুল করা হলো না, (যার কুরবানী কবুল করা হয়নি) সে বললো আমি অবশ্যই তোমাকে (যার কুরবানী কবুল করা হলো তাকে) হত্যা করবো, সে বললো, আল্লাহ তায়ালাতো শুধু পরহেযগার লোকদের কাছ থেকেই কুরবানী কবুল করে থাকেন'(সুরা আল মায়েদা-৫/২৭)।

আল্লাহ তায়ালার আইন অমান্য করার জন্যেই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম হত্যাকান্ড ঘটায় পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান আল্লাহর দ্বীনের শত্রু, ‘কাবিল’। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্ব প্রথম আল্লাহর আইন, বিধান বা দ্বীন অমান্য করা আর মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটালো আল্লাহর দ্বীনের শত্রু কাফের ‘কাবিল’। এটাই হচ্ছে নাস্তিক, কাফের ও শয়তানের কাজ, যা আল-কুরআনের সুরা আল মায়েদাসহ আরো কয়েকটি সুরায় উল্লেখ আছে। পৃথিবীতে কুরবানীর ইতিহাস ও হত্যার ঘটনা এখান থেকেই শুরু হয়েছে।

আজকে মুসলিম সমাজে কুরবানীর যে প্রচলন তা মূলত: মুসলিম মিল্লাতের বা জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ) এর দেখানো পথ বা সুন্নাত। হযরত ইব্রাহীম (আ) এর শতবর্ষ বয়সের পর আল্লাহ তায়ালা তাঁকে যে সন্তান দান করেছিলেন, তিনি আল্লাহ তায়ালা কতৃক আদিষ্ট হয়ে তাঁর সে কলিজার টুকরা হযরত ইসমাইল (আ) এর কুরবানীর সূত্র ধরে আজও কুরবানী প্রচলিত আছে।

হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর কুরবানীর সূত্রপাত : মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ) নমরুদ ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের অত্যাচারে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে নিজ স্ত্রী হযরত সারাকে সাথে নিয়ে শাম দেশে (সিরিয়া) হিজরত করলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে সেখানকার বাদশা ছিল জালিম ও ভীষণ বদ মেজাজী। বাদশার লোকেরা হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও তাঁর সুন্দরী স্ত্রী হযরত সারার আগমনের সংবাদ বাদশার দরবারে পৌঁছে দিলে বাদশা তাদেরকে ধরে নিয়ে আসতে বলে। বাদশার লোকেরা হযরত ইব্রাহীম (আ) ও তাঁর স্ত্রী সারাকে বাদশার দরবারে হাজির করে। বাদশা হযরত ইব্রাহীম (আ- এর কাছে জানতে চায় তার সাথে স্ত্রী লোকটি কে? ইব্রাহীম (আ) চিন্তা করলেন, স্ত্রী বললে হয়তো বা তাঁকে মেরে ফেলতে পারে, তাই তিনি বলেন সে আমার দ্বীনি বোন। বাদশা হযরত ইব্রাহীম (আ) কে বন্দী করে, আর হযরত সারাকে বাদশার বদস্বভাব চরিতার্থ করার জন্যে রেখে দেয়। বাদশার কু-প্রস্তাবে হযরত সারা রাজি নাহলে বাদশা তাঁকে হত্যার হুমকী দেয়। অত:পর হযরত সারা দু‘রাকা‘আত সালাত আদায় করার অনুমতি চাইলে বাদশা তাঁকে সালাত আদায়ের ব্যবস্থা করতে দেয়। হযরত সারা সালাত শেষে আল্লাহ দরবারে ফরিয়াদ করেন যেন আল্লাহ তায়ালা তাঁর সতীত্ব রক্ষা করেন। এরই মধ্যে বাদশা অত্যন্ত অসুস্থ্য ও দুর্বল হয়ে পড়ে। অবস্থা খারাপ দেখে আর বাদশার মৃত্যুর জন্যে তার লোকেরা হযরত সারাকে দায়ী করবে ভেবে হযরত সারা বাদশার সুস্থতার জন্যে দোয়া করেন। একে একে তিন বার একই ঘটনা ঘটলে বাদশা হযরত সারার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। হযরত সারার সতীত্ব দেখে আর এক সতী নারী হযরত হাযেরাকে তাঁর দাসী হিসেবে সঙ্গে দিয়ে তাঁদেরকে বিদায় করে দেয়।

হযরত সারা ও হযরত ইব্রাহীম (আ) মুক্ত হয়ে সে দেশে বসবাস শুরু করেন। হযরত সারা তাঁর দাসী হযরত হাযেরাকে হযরত ইব্রাহীম (আ)-এর সাথে বিয়ে দেন। কারণ হযরত সারার বয়স তখন ৯০ বছর আর হযরত ইব্রাহীম (আ) এর বয়স তখন ১০০ বছর। তাদের বিয়ের দীর্ঘ সময় পার হলেও তখনো হযরত সারা মা হতে পারেননি। তিনি ভাবলেন শেষ বয়সে যদি আল্লাহ তায়ালা মেহেরবানী করে তাঁর স্বামী হযরত ইব্রাহীম (আ) কে কোন সন্তান দান করেন। এই হযরত হাযেরার গর্ভেই হযরত ইসমাইল (আ)-এর জন্ম হয়।

হযরত ইসমাইল (আ)-এর জন্মের পর হযরত ইব্রাহীম (আ) তাঁর স্ত্রী হযরত হাযেরার কলিজার টুকরা ছেলেকে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে কা‘বা ঘরের নিকটবর্তী সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের পাদদেশে নির্জন স্থানে সামান্য কিছু খেজুর ও এক মসক পানিসহ রেখে আসেন। হযরত ইব্রাহীম (আ) যখন তাদেরকে এ অবস্থায় রেখে স্থান ত্যাগ করছিলেন, তখন হযরত হাযেরা প্রশ্ন করছিলেন, আপনি আমাদের এ নির্জন স্থানে রেখে চলে যাচ্ছেন? হযরত ইব্রাহীম (আ) ক্ষীণ কণ্ঠে জবাব দিয়েছিলেন, হ্যাঁ। আবারো হযরত হাযেরা প্রশ্ন করলেন, এটা কি আল্লাহ্ তায়ালার নির্দেশ? হযরত ইব্রাহীম (আ) আবারও জবাব দিয়েছিলেন, হ্যাঁ। হযরত হাযেরা আল্লাহ্ তায়ালার ওপর ভরসা করে তাঁর শিশু সন্তানকে নিয়ে সেখানেই অবস্থান করলেন।

সে সময় কা‘বা ঘরের তেমন কোন চিহ্ন ছিলো না। কা‘বা ঘরের ভিটিটি যমীন থেকে বেশ উঁচু ছিল। বৃষ্টির পানিতে সৃষ্ট বন্যায় চার পাশ ভেঙে গিয়েছিল। হযরত হাযেরা ও তাঁর সন্তানের খাদ্য ও পানীয় যখন শেষ হয়ে গেল হযরত হাযেরা তখন খাদ্য ও পানির সন্ধানে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে দৌড়া দৌড়ি শুরু করেন। যখন নিরাশ হয়ে ফিরছিলেন তখন একটি আওয়াজ শুনতে পান। হযরত হাযেরা বলেন, কে আছ আমি তোমার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি, সম্ভব হলে তুমি আমাকে আল্লাহর ওয়াস্তে একটু সাহায্য করো। হঠাৎ তিনি তাঁর শিশু পুত্র ইসমাইল (আ)-এর কাছে একজন লোক (ফেরেশতা) দেখতে পেলেন। সে (ফেরেশতা) তাঁর পায়ের গোড়ালী অথবা ডানা দ্বারা যমীনে আঘাত করলে অথবা হযরত ইসমাইল (আ)-এর কান্নাজনিত পায়ের গোড়ালীর ঘর্ষণে নীচ থেকে পানির ফোয়ারা প্রবাহিত হতে লাগলো। এ সেই ফোয়ারা বা কূপ যা বর্তমানে যমযম নামে বিশ্ব মুসলিমের কাছে পরিচিত। যে সুপেয় পানীয় হিসেবে পান করে পরিতৃপ্ত হয় মুসলমাগণ। তাও কা’বাকে কেন্দ্র করে ও হযরত ইসমাইল (আঃ)-এর উছিলায় আল্লাহ তায়ালার করুণায় সৃষ্টি হয়েছে।

হযরত হায়েরা তাঁর মশক পূর্ণ করে নিলেন আর নিজেও তৃপ্তির সাথে পানি পান করলেন। এতে তাঁর ক্ষুধা নিবারণ হলো ও তাঁর শিশু পুত্রের জন্যে প্রয়োজনীয় দুধেরও ব্যবস্থা হলো। হযরত হাযেরা সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে ক্রমাগত ৭ বার দৌড়াদৌড়ি করার কারণে সে ঘটনাকে কেন্দ্র করে আল্লাহ সোবহানাহু ওয়া তায়ালা হজ্জ ও ওমরাহ পালনকারীদের জন্যে সাফা মারওয়া পাহাড়ে ৭ বার দৌড়াদৌড়ি করার বিধান জারি করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘‘অবশ্যই ‘সাফা ও মারওয়া’ পাহাড় দু’টো আল্লাহ তায়ালার নিদর্শন সমূহের অন্যতম, অতএব, যদি তোমাদের মধ্যে কোন লোক হজ্জ বা ওমরাহ আদায় করার এরাদা করে তার জন্যে এই উভয় পাহাড়ের মাঝে ‘সাঈ’ করতে হবে। কেননা যদি কোন ব্যক্তি অন্তরে নিষ্ঠার সাথে কোন ভালো কাজ করে তাহলে তারা যেন জেনে রাখে, নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়ালা কৃতজ্ঞতাপরায়ণ ও প্রভূত জ্ঞানের অধিকারী’’ (সূরা বাকারা-২/১৫৮)।

হযরত ইসমাইল (আঃ) এর যখন হাঁটা-চলা ও খেলাধুলা করার বয়স তখন হযরত ইব্রাহীম (আঃ)কে স্বপ্নে আদেশ করা হলো, তুমি তোমার প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে কুরবানী করো। ইব্রাহীম (আঃ) স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে ১০ টি উট কুরবানী করলেন। পুনরায় তিনি আবারো একই সপ্ন দেখলেন। অতপর ইব্রাহীম (আঃ) আবারো ১০০ টি উট কুরবানী করলেন। আবারো তিনি একই সপ্ন দেখে ভাবলেন, আমার কাছেতো এ মুহূর্তে আমার কলিজার টুকরা প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আঃ) ছাড়া আর তেমন কোন প্রিয় বস্তুু নেই। আল্লাহ তায়ালা বলেন, অতঃপর আমি তাকে (হযরত ইব্রাহীম (আঃ)কে একজন ধৈর্য্যশীল পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দান করলাম। সে যখন পিতার সাথে হাঁটা-চলার উপযোগী হলো, তিনি (ইব্রাহীম আ:) বললেন, হে আমার পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে কুরবানী করছি। সুতরাং তোমার মতামত কি? সে (হযরত ইসমাইল আ:) বললেন, হে আমার পিতা! আপনি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছেন তা পালন করুন। আপনি আমাকে আল্লাহর মেহেরবাণীতে ধৈর্য্যশীলদের একজন পাবেন। অতঃপর যখন তাঁরা দু’জন একমত হলো আর আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছার সামনে আত্মসমর্পণ করলো এবং ইব্রাহীম (আঃ) ইসমাইল (আঃ) কে জবাই করার জন্যে কাত করে শুইয়ে দিলো; তখন আমি ইব্রাহীমকে ডাকদিয়ে বললাম, হে ইব্রাহীম তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্যে রূপ দিয়েছো। নিশ্চয়ই এটা ছিল ইব্রাহীম ও ইসমাইলের জন্যে একটা পরীক্ষা। অতঃপর আমি ইব্রাহীমকে দান করলাম একটি মহা কুরবানীর পশু। অনাগত মানুষের জন্যে এ (কুরবানীর) বিধান চালু রেখে, তাঁর স্মরণ আমি অব্যাহত রেখে দিলাম। শান্তি বর্ষিত হোক ইব্রাহীমের ওপর। আমি এভাবেই সৎপরায়ণ ব্যক্তিদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। ’’(সুরা আস সফফাত-১০১-১০৯)।

কুরবানীর তাৎপর্য ও গুরুত্ব :- হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, কতিপয় সাহাবা রাসূল (সাঃ)কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) কুরবানী কি? রাসূল (সাঃ) বললেন, কুরবানী মুসলিম মিল্লাতের বা জাতির পিতা ইব্রাহীম (আঃ) এর সুন্নাত। তারা আবারো প্রশ্ন করলেন, এর মধ্যে আমাদের জন্যে কি আছে ? রাসূল (সাঃ) বললেন, কুরবানীর পশুর প্রতিটা পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকী আছে। তারা বললেন, ভেড়ারতো অসংখ্য পশম আছে। রাসূল (সাঃ) বললেন, ভেড়ার প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকী দেয়া হবে, যদি তা খালেস নিয়তে কুরবানী করা হয়’ (ইবনে মাযাহ)। আবু দাউদ শরীফের এক হাদীসে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে মর্যাদার দিন হচ্ছে কুরবানীর দিন।

কুরবানীর শিক্ষা: কুরবানী কোন চাপ বা জবদস্তির বিষয় নয়। মানুষ সেচ্ছায় তার প্রতিপালকের সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় সবচাইতে প্রিয় বস্তুু ত্যাগ করার মানসিকতা সৃষ্টি করে। যেমন হযরত ইব্রাহীম (আঃ) শুধু মাত্র স্বপ্নে দেখেছেন, তোমার প্রিয় বস্তু আল্লাহর রাহে কুরবানী করো। আর অমনি তিনি তাঁর আদরের একমাত্র সন্তান হযরত ইসমাইল (আঃ)কে কুরবানীর জন্যে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। পৃথিবীতে মানুষের কাছে সবচাইতে আকর্ষণীয় বস্তুর মধ্যে অর্থ-সম্পদ বা টাকা-কড়ি আর সন্তান অন্যতম। মহান আল্লাহর প্রেমে ও তাঁর নির্দেশের প্রাধান্য দানকল্পে। এই অর্থ-সম্পদের মোহ ত্যাগের এ মানসিকতা সৃষ্টি করাই হচ্ছে কুরবানীর শিক্ষা। কুরবানী আমাদের ঈমান ও তাকওয়া বৃদ্ধি করে ও পরকালের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে। রাসূল (সাঃ) নির্দেশ করেছেন, হে লোকসকল তোমরা ত্রুটিমুক্ত ও উত্তম প্রাণী কুরবানী করো, কারণ কুরবানীর এ পশুগুলো হবে তোমাদের জান্নাতে যাওয়ার বাহন'(বায়হকী)।

কুরবানী সচ্ছল সকল মুসলমানের ওপর ওয়াযিব। কুরবানীর গোস্তের ওপর আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর, গরীব-মিসকিনের ও মুসাফিরের হক আছে। খেয়াল রাখতে হবে সমাজের কোন একজন ব্যক্তিও যেন কুরবানীর গোস্ত থেকে বঞ্চিত না হয়। কিন্তু কুরবানীর চামড়া শুধু মাত্র যাকাতের হক দারদেরই প্রাপ্য। কুরবানীর ব্যাপারে দৃষ্ট আকর্ষণ :- আমাদের সমাজে উট, গরু, মহিষ এ ধরনের পশু ৭ ভাগে কুরবানী করা হয়। এক্ষেত্রে সমমনা ও সম-আর্থিক সঙ্গতি সম্পন্ন লোকদেরই একত্রে কুরবানী করা উচিত। অনেকেই আবার কুরবানীর পশুতে আকিকার জন্যে এক ভাগ বা দুই ভাগ রাখেন। এতে আকিকা সহীহ হবে না। আকিকার জন্যে ছেলে হলে দু’টি ভেড়া বা বকরী আর মেয়ে হলে একটি ভেড়া বা বকরী নির্ধারণ করতে হবে। আর মনে রাখতে হবে কুরবানীর সাথে আকিকার কোন সম্পর্ক নেই। কুরবানী ঈদ-উল আজহার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ও ধনীর জন্যে এটা আনন্দের আর গরীবের জন্যে স্বস্তির।

লেখক: গাজী মুহাম্মাদ শওকত আলী

 

পরামর্শ–১১

দু’টি ইটকে জোড়া লাগাতে তৃতীয় বস্তু
সিমেন্ট-বালির মিশ্রনের দরকার হয়!

দু’টি কাঠকে জোড়া লাগাতে তৃতীয় বস্তু
লোহা/আঠার প্রয়োজন দেখা দেয়!

দু’টি কাঁপড়ের টুকরোকে জোড়া লাগাতে
তৃতীয় বস্তু সুই-সুতার সেলাই করতে হয়!

ঠিক এভাবেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা
‘প্রত্যেক দুই খন্ডকে’ জোড়া লাগাতে তৃতীয় বস্তুর ব্যবস্থা রেখেছেন!
সুতরাং দু’টি দিল বা বহু দিলকে পরষ্পর জোড়া
লাগাতেও নিশ্চিত তিনি তৃতীয় আরেকটি বস্তু তৈরী/ব্যবস্থা করে থাকবেন এবং করে রেখেছেন!
আর ঐ তৃতীয় বস্তুটির নাম হলো- ‘ দ্বীনে ইসলাম’ !
অতএব, যেই পরিবারে/দেশে দ্বীনে ইসলামের প্র্যাক্টিস/অনুসরণ যতো বেশি থাকবে, নিশ্চিত ঐ পরিবারে/দেশে মানুষের পারষ্পরিক দিলের বন্ধন বা আত্মার সম্পর্ক ততো বেশি মজবুত ও দৃঢ় থাকবে ৷ ফলে, গোটা দুনিয়ায় শান্তির সু-বাতাস বইবে ৷
কাজেই, আসুন! যদি পরিবারে শান্তি চাই, তবে দ্বীনে ইসলামের প্র্যাক্টিস বাড়িয়ে দিই! যদি দেশে শান্তি চাই, তবুও সর্বত্র দ্বীনে ইসলামের প্র্যাক্টিস/অনুসরণ বাড়িয়ে দিই!

 

পরামর্শ–১০

বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়াতে যত্রতত্র
বিশ্বমুসলিম নির্যাতনের গা শিউরে উঠা
ভিডিও ক্লিপগুলো আমরা দেখতে পাই!
বিশ্বসন্ত্রাসীরা আমাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করে ভিডিও ক্লিপগুলো আবার আমাদের ভাইদেরকেই দেখিয়ে কাটা ঘায়ে নতুন করে মরিচগুঁড়ো ছিটাচ্ছে– আমাদের হৃদয়টাকেও আহত করার জন্য! এতেই ওরা আনন্দিত, উল্লসিত!
হৃদয়টা যদি সত্যিই আহত হত, তবে আমাদের উপকারই হত! ভবিষ্যৎ গোছাতে পারতাম! কিন্তু, পাথরে হৃদয় আমাদের ব্যথিত হয় না, আহত হয় না! যেটা হয়, তা হলো- অ্যাকশনধর্মী, রক্তাক্ত সিনেমার অভিনয় মনে হয়! ধর্ষণের অভিনয় মনে হয়! ফলে, নির্যাতনের ভিডিওগুলো দেখলে অনেকেই মন্তব্য করে, এটা মনে হয় অভিনয়, পুরোপুরি সত্য নয়, অমুক মুভির কাটপিস, কম্পিউটারে এডিট করা ইত্যাদি! নাঊযুবিল্লাহ ৷
বলা যায়, শয়তানগুলো তাদের মিশনে বেশ সফল!
একদিকে তারা নানাভাবে এবং নানাআয়োজনে মুসলিমহৃদয়ে বিষবাষ্প ঢেলে দিয়ে আমাদের চিন্তা-চেতনাকে ভোঁতা করে দিচ্ছে, অন্যদিকে তারা আমাদের কতককে মেরে কতকের হৃদয়ে তীব্র যন্ত্রণার পাহাড় চাঁপিয়ে দিচ্ছে!

বিশ্বমুসলিমদের তাই আরো সতর্ক হওয়া চাই! দায়িত্ত্ববান হওয়া চাই! ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য করে চলা চাই!

নাটক-সিনেমা, বিশ্বকাপ ফুটবল/ক্রিকেট খেলা ও চোখধাঁধাঁনো আয়োজনগলো উপভোগ করার আগে আরেকটু ভেবে-চিন্তে নেওয়ার উন্মুক্ত পরামর্শ রইলো সবার প্রতি!

 

পরামর্শ–০৯

রাগে-ক্রোধে ভরা বর্তমানের অধিকাংশ মানুষ!
রাগ-ক্রোধ তো প্রায় সবারই আছে, তবে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষের সংখ্যা বলা চলে বিরল! মনে পড়ে, রাগের মাথায় কত কিছুই না ভেঙেছি এই জীবনে! বলেছি আরো কত কী! আপনারও মনে পড়ার কথা! কিন্তু, সত্যি বলতে কী- ঐ নিয়ন্ত্রণহীন রাগ-ক্রোধ এই জীবনে কখনো-কোথাও কল্যাণের বার্তা বয়ে আনে নি আমার জন্য! হয়তো আপনার জন্যও আনে নি! আনার কথাও না!
দেখুন তো, রাগ করলে সাধারণতঃ আমরা কী কী করি? হয়তো কিছু ভেঙে ফেলি, নয়তো কিছু বাজে বকি, কিংবা অন্য কোন অঘটন ঘটাই! এগুলোর একটিও যে আমার জন্য কল্যাণকর নয়, তা আমাদের প্রায় সবার কাছেই পরিস্কার! কারণ, কিছু ভাঙলেও আমার ক্ষতি, বাজে বকলেও আমার নোংরামী, আর অন্য কোন অঘটন ঘটালেও আমার ফাইজলামী!
সুতরাং পরামর্শ হলো, আমরা যেন রাগের মাথায়ও নিজের উপর রাজত্ত্ব করি এবং নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে না ফেলি! সাথে সাথে ইমাম গাজালী রহ. এর ” ক্রোধ দমন ” বইটিও পড়তে পারি! পোস্টটি পড়ার জন্য জাযাকাল্লাহ!

 

পরামর্শ–০৮

ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন সাইটে আমরা যারা কম-বেশি লেখা-লেখি করি, তাদের প্রতি–
অনেক সময়ই অনলাইনে কাছের ও পরিচিতজনদের করা এমন কিছু পোস্ট সামনে পড়ে, যা দেখে ও পড়ে রীতিমত বিস্মিত হই! হায়, ‘চক্ষু লজ্জা’ বলেও তো একটা কথা আছে নাকি! তাছাড়া, এটা তো সবারই জানা থাকার কথা যে, ফ্রেন্ড লিস্টে তার কে কে আছে! অন্যায় তো সবখানেই অন্যায়! আর তা যদি হয় নিজের কাছের ও সম্মানীতজনদের সামনে?! তাহলে? ..

” যা কিছুই লিখি না কেন, সাথে সাথে একটু
হলেও যেন খেয়াল রাখি- আমার এই লেখাটা কিন্তু অনেকের সামনেই পড়বে! কাজেই, অবিবেচকের ন্যয় এমন কিছু যেন না লিখি, যা আমাকে অনেকের সামনেই লজ্জায় ফেলতে পারে! ” জাযাকাল্লাহ ৷

 

পরামর্শ–০৭

অধীনস্তজনদের নিয়ে যাদের চলতে হয়,
ব্যবসা-বাণিজ্যে, অফিস-আদালতে কিংবা
অন্য কোন কর্মস্থলে, তাদের প্রতি পরামর্শ-
” অধীনস্তদের সাথে সুন্দর ব্যবহার করুন!
তাদেরকে আদব শেখান এবং মাঝে মাঝেই
অফিসিয়াল কানুন সম্পর্কে অবহিত করুন!
কাছে টানুন ও ভালোবাসুন! কিন্তু, মাঝে মাঝে ‘কৌশলি ধমক’ও দিন, যাতে আপনাকে আবার পার্টনার ভাবার সুযোগও না পায়! সেটা হলেও বিপদ! যাইহোক, এই ধমক শত্রুতার নয়, এই ধমক কৌশলের!
মনে রাখতে হবে, ধমক কৌশলেরই হোক আর শাসনেরই হোক, হাসিমুখে শেষ ভালোবাসাটা কিন্তু আপনাকে দিতেই হবে! এটা না হলেও বিপদ! “

 

পরামর্শ–০৬

সম্পর্ক বড় দামি ও স্পর্শকাতর জিনিস ৷ খুব কঠিন শর্তে টিকিয়ে রাখতে হয় এই সম্পর্ক ৷
সম্পর্ক তো গড়া যায় যখন-তখন ৷ সামান্য
ভুলে কখনো কখনো তা আবার চুরমারও হয়ে যায়! তাই, সম্পর্ক যদি হয় সু-সম্পর্ক এবং তা স্থায়ী হোক এমন বাসনা থাকে মনে, তবে অনেক কিছুর সাথে যে বিষয়ের প্রতি অবশ্যই লক্ষ্য রাখা চাই, তাহলো– ” বন্ধু যেন কিছুতেই বুঝতে না পারে, আপনি তাকে কম গুরুত্ত্ব দিচ্ছেন! ”
আজকাল এই ভুলটা আমরা প্রায়শঃই করে থাকি ৷ যা সাধারণতঃ বন্ধুদের ইগোতে/চিন্তার জগতে মারাত্মকভাবে আঘাত হানে! এটা কিছুতেই কাম্য নয় ৷ উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়– ” বন্ধুর সাথে আপনি কিছু সুন্দর মুহুর্ত কাটাচ্ছেন, গল্প করছেন .. এমন সময় হঠাৎ ক্রিং ক্রিং টেলিফোন বা মোবাইল বেঁজে উঠলো, ফোন তো উঠাতেই হবে, তবে বন্ধুর কাছ থেকে যদি নেওয়া যায় ইশারায় একটু সম্মতি, তবে মন্দ কী তাতে! তারপরে আবার, বন্ধুকে উপেক্ষা করে মোবাইলে দীর্ঘালাপ শুরু করা! এটা বড় ভুল ৷ প্রয়োজন তো অল্পতেও সাড়া যায়! বন্ধুর দেমাগে বিষয়টা কিন্তু স্বভাবতই হিট করার কথা! তাই বন্ধু যখন কাছে আছে, তো আমি যতক্ষণ তাকে সময় দেবো, ততক্ষণ ছোট দরকারে কাউকে ফোন দেবো না! ফোন এলে বা দিলেও প্রয়োজন সাড়ার মতো অল্প কথায় ফোন রাখবো! বন্ধুত্ত্ব হবে তখন আত্মার সাথে! স্থায়ী বন্ধুত্ত্ব!
পাশাপাশি আরেকটা কমন ভুল, যেটা আমরা করে থাকি, তাহলো- ” বন্ধু আমার সাক্ষাতে এলে এ কথা আমি তাকে বোঝাতে পারি না যে- বন্ধু, তোমার আগমনে আমি মনে-প্রাণে খুশী! ”
তাই, পরামর্শ হলো- বন্ধুকে যেন আমরা যথাযথ গুরুত্ত্ব দিই এবং তার আগমনে যে আমি মনে-প্রাণেই খুশী, তা তাকে বুঝতে সহযোগিতা করি ৷

 

পরামর্শ–০৫

নতুন বিয়ে যারা করছেন, তাদের প্রতি!
প্রায়শঃই দেখা যায়– আমরা প্রায় অধিকাংশরাই নববধু পেয়ে বিয়ে এবং বিয়ে পরবর্তী এক-দেড় মাস কিংবা তার চেয়েও বেশি সময় যাবৎকাল পরিচিতদের সাথে বিয়েপূর্ব সময়ের ন্যায় যোগাযোগ রক্ষা করে চলি না বা অপরিচিতের মতো হয়ে থাকি!
যারফলে, প্রায় সব সার্কেলেই কিছুটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা না দিলেও ‘মৌন হতাশা’ তো অবশ্যই দেখা দেয় ৷ ফলে, মনে হতেই পারে তাদের- ‘ পাল্টে গেছে জনাব! ‘ তাই পরামর্শ, জামাই বাবুরা বিষয়টা একটু ভেবে দেখতে পারেন!

 

পরামর্শ–০৪

আমাদের প্রায় সবারই কাছের এমন কিছু
বন্ধু-বান্ধব বা পরিচিতজন থাকেন, যাদের
সাথে আমরা খুব ফ্রেন্ডলি মিশি এবং স্বহাস্য
সব ধরণের গল্পও করে থাকি ! যার ফলে
প্রায়শঃই দেখা যায়, আমরা ও তারা পরষ্পর
রসালো গল্প বা খুব সাধারণ কথোপকথনের
সময়েও এমন এমন শব্দ ও বাক্যের ব্যবহার
করে থাকি, যা অন্য দশ জনের সামনে বলতে
কিছুটা হলেও লজ্জা বা ইতস্তবোধ করি! অথচ
সম্পর্কের দোহাই দিয়ে সেই সকল শব্দ ও বাক্যই
আজ আমরা অবাধে এই অনলাইন মিডিয়া
এবং পাবলিক প্লেসেও ব্যবহার করছি প্রতিনিয়ত!
ফলে লজ্জিত হচ্ছি আমরা সবাই! কারণ,
বিভিন্ন ক্যাটাগরি বা শ্রেনী-পেশার মানুষ
নিয়েই আমাদের ব্যক্তি জীবন সাজানো থাকে!
পরামর্শ হলো,
আমরা যেন বিশেষ করে অনলাইন মিডিয়া
এবং পাবলিক প্লেসে অপর ভাই ও বন্ধুর
সম্মানের প্রতি যথেষ্ট খেয়াল রাখি ! কারো
সামনে কাউকেই যেন লজ্জিত হতে না হয়!

 

পরামর্শ–০৩

ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়ায়
মাঝে মাঝেই হয়তো দেখে থাকবো যে–
বিভিন্ন প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে বিভিন্ন
ইসলামি দল ও জাতির কর্ণধার মুহতারাম
আলেম-উলামাদের নিয়ে খুব জঘন্য এবং
অশালীন ভাষায় মন্তব্য করা হচ্ছে! আমি
নিজেও বহু দেখেছি! এমতাবস্থায় আমার
পরামর্শ হলো, ” ভিন্ন মত ও ভিন্ন পথেরও
যদি হয়, যৌক্তিক সমালোচনা এবং মার্জিত
ভাষায় যেন করি! অসুন্দর ও অবমাননাকর
শব্দ/বাক্যগুলো যেন আমরা পরিহার করি!
আর যেখানে আমার করা মন্তব্যকে অনর্থক/
বে-ফায়েদা মনে হবে, সেখানে যেন সবচেয়ে
নিরাপদ রাস্তা ‘চুপ থাকা’টাকেই বেছে নিই ! “

 

পরামর্শ–০২

হাফেজে কুরআন যারা খতমে তারাবীহ
পড়াচ্ছেন, তাদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা ৷

যথেষ্ট দুঃখজনক হলেও সত্য যে,
সারা বছর অন্য সবকিছু করার সময় পেলেও ‘আমরা অনেকেই’ কুরআনে হাকীম তিলাওয়াতের সুযোগ তেমন পাই না ! কেন পাই না? .. আল্লাহ মা’লূম ! ফলে কুরআন আমাদের দিলে ঘুমিয়ে থাকে ! জাগ্রত থাকে না ! কিন্তু, যবে থেকে রমযান শুরু হয়ে গেলো, সেই ঘুমন্ত কুরআনকে জাগাতে দিন-রাত এক করে তিলাওয়াতে মহা ব্যস্ত হয়ে পড়ি আমরা! সওয়াবের আশায় নয়; তারাবীহ পড়াতে হবে যে ! আল্লাহ মাফ করুন ৷
যাইহোক, তারাবীহ তো পড়াতেই হবে! সেজন্য প্রস্তুতির অংশ হিসেবে পর্যাপ্ত পরিমান তিলাওয়াতও করতে হবে!
কিন্তু, দিন-রাত এক করে না ঘুমিয়ে রমযানে যেন আর এতো মেহনত করতে না হয় বা মেহনত কম করলেই চলে, সেজন্য একটি পরামর্শ ! মানলে কাজে দিবে, নিশ্চিত ! ইনশা আল্লাহ ৷

→ প্রতিদিনের তারাবীহের জন্য যেই পরিমান
তিলাওয়াতের প্রস্তুতি আমরা নিয়ে থাকি ,
ঐ এক-দেড় পারা কুরআন আমরা যেন খুব
ভালোভাবে আয়ত্ত্ব করে নিই! তারাবীহ পূর্ব
সময়ে কাউকে যেন শুনিয়ে নিই! তারাবীহের
পরে যেন কোথাও কোনো ভুল আছে কি না,
শুধরে নিই! সাহরী খেতে উঠবো যখন, তখন
যেন তাহাজ্জুদে দাঁড়িয়ে পুনরায় তা মালিককে
শুনিয়ে দিই! এভাবে যেন প্রতিদিনের আমল
প্রতিদিন করে পুরো একটি মাস কাটিয়ে দিই!
বিশ্বাস করুন, আপনার এই এক মাসের আমল
আপনাকে কমপক্ষে আগামী পাঁচ বছর পর্যন্ত
এনার্জি যোগাবে! প্রতি বছরই যদি এই আমল
জারী রাখা যায়, তাহলে কুরআনের প্রতিটি সূরা ও
আয়াত আপনার সামনে হার হালতে আয়নার
ন্যায় ভাসছে মনে হবে, ইনশা আল্লাহ ৷

তাছাড়া, সারা বছর দৈনন্দিন তিলাওয়াতের
অভ্যাশ তো হাফেজদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ৷

 

পরামর্শ–০১

আলিম-উলামা ও ত্বলাবা যারা আছেন-
লেখা-পড়ায় কিংবা চেহারায় একটু কম
হলেও মাদ্রাসা পড়ুয়া মেয়েদেরকেই বিয়ে
করা উচিত ৷ একটু সময় বেশি লাগলেও!
বিপরীত হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংসার
টিকে না অথবা সংসারে শান্তি আসে না ৷
পরিক্ষীত, ব্যতিক্রমের সংখ্যা খুবই নগন্য ৷

ভিন্ন পরিবেশের একটি মেয়ে হঠাৎ করেই
বদলে যেতে পারে না ৷ সম্ভব হয়ে উঠে না ৷
যে মেয়েটি আগে থেকেই পর্দা রক্ষা করে
চলা শিখেনি, নামাযের পাবন্দি করেনি এবং
গান-বাদ্য ও নাটক–সিনেমাকে হারাম বলে
জানে নি, সে কীভাবে কারো কথায় হঠাৎ
করেই বদলে যাবে ?! কীভাবে তা সম্ভব? ..
সে তো নিজেকে ‘বন্দী পাখি’ মনে করবে !
আর সবকিছুই তার কাছে নিশ্চিত বাড়াবাড়ি
মনে হবে ! অবশেষে দেখা যাবে, লাজ–শরম
ও মান-ইজ্জতের মাথা খেয়ে সংসার ভাঙছে!
কিছুই ভাববে না সে ! কিছুই মনে করবে না !

মান হারাবে আপনার এবং শুধুই আপনার ..

 

কবূলিয়াত বড় দামি জিনিস

ভাবনার বিষয় ৷ মনে করে দেখুন—
খুব কাছে থেকে দেখা অনেককেই
দেখে মনে হতো- ‘ঝরে যাবে হয় তো’!
কিন্তু, না! ঝরে যায় নি সে/তারা ৷ ..
তাদের অনেকেই আজ সমাজ, দেশ ও
জাতির স্বার্থে বড় বড় কাজ করছে!
” আল্লাহ তাদের কাজে লাগিয়েছেন ! ”
আজ তারা সফল ব্যক্তিত্ত্ব প্রমাণে বেশ
এগিয়ে ৷ সে জন্যই তো, কবূলিয়াত বড়
দামি জিনিস ! কিছুই বোঝার উপায় নেই ৷

 

চলে গেলেন ড. আফিয়া সিদ্দীকা

মরে গিয়ে বরং বেঁচেই গেলেন কোরআনের হাফেজা আফিয়া সিদ্দিকা । বিশ্বের একমাত্র নিউরো সাইন্টিস্ট ড. আফিয়া সিদ্দিকা অবশেষে মুক্তি পেলেন নারকীয় যন্ত্রনা থেকে। নিস্তার পেলেন মার্কিনী ধর্ষকদের খেলা ও বিশ্ব দর্শকদের হেলা থেকে। বেঁচে গেল পিচ্চি মেয়ে মালালাও।

আশ্চর্য এক ম্যাসেজ মিলছে এ দু’জন থেকে। দু’জনই পাকিস্তানি। মালালা স্কুল পড়ুয়া এক কিশোরী আর আফিয়া হলেন পি.এইচ.ডি হোল্ডার। একজনকে ওরা খুবলে খায় আর অন্যজনকে নিয়ে মেতে ওঠে পরিকল্পিত খেলায় !
.
ড. আফিয়াকে আল-কায়েদার সাথে জড়িত সাজিয়ে ইউএস আদালত সাজা দেয়। সাথে দেয় গণ ধর্ষণের অলিখিত লাইসেন্স। আর মালালাকে কোলে তুলে গেয়ে উঠে মানবতার গান ! বিশ্ববিবেক গা ভাসায় স্রোতের অনুকূলে আর মানবতার ধ্বজাধারীরা বসে থাকে মুখে কুলুপ এটে।

আন্তর্জাতিক মিডিয়ার চোখ এড়িয়ে যায় এ দিকটা। আরব্য মুসলিম শাসকগণ তো আগ থেকেই হাতে চুড়ি আর পায়ে দাসত্বের বেড়ি পরা। দেখতে থাকে, বুঝতে থাকে আর গাইতে থাকে মনে মনে, তুমি চোর হইয়া চুরি করো আর পুলিশ হইয়া ধরো, সর্প হইয়া দংশন করো ওঝা হইয়া ঝারো!
.
দুইঃ
.
২০০৩ সালে প্রথমে কিডন্যাপ করা হয় ড. আফিয়াকে। এ কিডন্যাপিংয়ে সহায়তা করে খোদ পাকিস্তান সরকার। গুম করে রাখা হয় ২০০৮ পর্যন্ত। নিয়ে যাওয়া হয় আমেরিকান টর্চার সেলে। চলতে থাকে দিনের পর দিন গণ ধর্ষণ। তাকে উলঙ্গ করে কুরআন শরীফের পাতা ছিড়ে মেঝেতে বিছিয়ে রেখে বলা হত, যাও! কুরআনের উপর দিয়ে গিয়ে কাপড় নিয়ে এসো। ড. আফিয়া সেটি করতে পারতেন না। কারণ, তিনি মুসলমান।
.
কারণ তিনি কুরআনকে ভালবাসতেন। ৩০ পারা কুরআন তার বুকে ছিল। তিনি একজন হাফেজাও ছিলেন। ফলে তার উপর নির্যাতনের মাত্রা আরো বেড়ে যেত।
.
২০০৮ সালে তাকে নিয়ে সাজানো হল মূল নাটক। এক মার্কিনী খ্রিষ্টান সেনা হত্যা চেষ্টার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার দেখানো হল। শুরু হয় বিচারিক প্রহসন।
.
আমেরিকান আদালত তাকে ৮৬ বছরের সাজা ঘোষণা করে! একজন নারী, একজন মুসলিম সাইন্টিস্ট কুরআনে হাফেজাকে নিয়ে বিশ্ব মোড়লরা মেতে উঠলো নোংরা খেলায়। ছয়’শ কোটি মানুষের এ পৃথিবীতে দেড়’শ কোটি মুসলমানের এ দুনিয়ায় কেউ কিছু বললো না!
.
আশ্চর্য এক পৃথিবীতে আমাদের আবাস ! ড. আফিয়ার বিরুদ্ধে প্রহসনের বিচারিক রায় ঘোষণার সময় তাকে কিছু বলতে বলা হলে বিচারকের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন :

আপনি তাদের ক্ষমতা দিয়েছেন আমাকে রেফ করার, উলঙ্গ করে সার্চ করার! আপনার কাছে কিছুই বলবার নেই আমার। আমি আমার আল্লাহর কাছে যেয়েই যা বলার বলবো। আমি তো সেদিনই মরে গেছি, যেদিন আমাকে প্রথম ধর্ষণকরা হয়েছিলো। আমাকে ছেড়ে দিন। আমাকে আমার দেশে যেতে দিন।
.
সেই আফিয়া মারা গেলেন অবশেষে। আমি বলি মারা যাননি, আসলে তিনি বেঁচেই গেলেন।

২০০৩ থেকে মরে ছিলেন তিনি। মৃত্যুর মাধ্যমে বরং বেঁচে গেলেন তিনি। তাকে আর খুবলে খাবে না পিশাচের দল! তাকে আর বিবস্ত্র করে বলা হবে না, যাও কুরআনের উপর পা রেখে কাপড় নিয়ে এসো গিয়ে!

উফ! কী অসহ্য যন্ত্রনার-ই-না ছিলো নয়’টি বছর!

ড. আফিয়ার সাথে নোংরা খেলার এ নায়কদেরই যখন দেখি মালালাকে নিয়ে মাথা ঘামাতে, হা হুতাশ করতে, মানবতার পক্ষে বড় বড় বুলি আওড়াতে, তখন সন্দেহ করতে ইচ্ছে করে মালালা তাদের নিজেদেরই প্রডাকশন কি না! অথবা উদ্দেশ্য হাসিল করবার জন্যে তারা নিজেরাই তালেবান সেজে মেয়েটিকে গুলি করেছে কি না!
.
তিনঃ

বিশ্বের একমাত্র স্নায়ূ বিজ্ঞানী ড. আফিয়া সিদ্দিকা’র মূল অপরাধ ছিল তিনি এতো উচ্চ শিক্ষিত হয়েও কুরআনের প্রতি ঝুকে ছিলেন কেনো? কুরআন থেকে কেন রেফারেন্স টানতেন?

১৯৯৩ সালের একটি ভিডিও ক্লিপের সৌজন্যে আমার সুযোগ হয় একুশশতকের এ হযরত সুমাইয়ার বক্তব্য শোনার। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম আমার বোনের কথাগুলো। কুরআনের একটি একটি আয়াত তেলাওয়াত করে বৈজ্ঞানিক সূত্রে কথা বলছিলেন তিনি। তিনি বলছিলেন, ইসলাম হলো নারীর সুরক্ষক। ড. আফিয়া সিদ্দিকার বক্তব্যের অংশ ইউটউব থেকে দেখতে পারেন।

মানুষটিকে ওরা মেরে ফেলল তিলে তিলে। অকথ্য নির্যাতন করে। বিশ্ব মিডিয়া চেপে গেলো খবরটি সেই প্রথম থেকেই। ইন্টারনেটে প্রকাশিত এক চিঠিতে মুসলিম জাতিকে তিনি ঘুমন্ত মৃত জাতি বলে সম্ভোধন করে কিছু আক্ষেপের কথা বলেছিলেন।

বলে ছিলেন, আমি আর তোমাদের সাহায্যের আশা করি না। আমি তোমাদের বোন না। তোমরা কেউ মুহাম্মদ বিন কাসেম না। আমি আমার আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাই, আর কারো কাছেই না। আফিয়া মিথ্যে বলেননি মোটেও।
.
সেকুলার লিবারেল ছোট্ট একটি মেয়ে মালালাকে এ সময়ের সেরা বুদ্ধিজীবি বানিয়ে বিশ্ব মিডিয়ায় তোলপাড় শুরু হলো আর ওদিকে আফিয়ার উপর চলতে থাকলো পৈশাচিক নির্যাতন। কেউ কিছু বললো না। কেউ বললো না ছোট্ট মেয়ে মালালাকে যে বা যারাই গুলি করেছে, অন্যায় করেছে, চরম অমানবিক কাজ করেছে। তালেবানরা এটা করে থাকলে তাদের অনুকম্পা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। দোষীদের খোঁজে বের করে ফাসিতে ঝুলানো উচিত।

কিন্তু কথা তো এখানেই শেষ হতে পারে না। এক মালালাকে নিয়ে এতো দৌড় ঝাপ কিন্তু বিশ্বে যে আরো মালালা আছে। ইরাকে, আফগানে, ফিলিস্তিনে, পশ্চিমা ন্যাটো ঝুটের অবিরত ড্রোন হামলায় যে মালালারা মারা যাচ্ছে, তাদের কী হবে?
.
২০০১ থেকে এ পর্যন্ত শুধু আফগানিস্তানেই মারা হয়েছে ১৩ হাজার ২শ থেকে বেশি শিশু। যাদের বয়স ১৫ থেকে কম। অর্থাৎ যারা প্রত্যেকেই এক একজন মালালা। এদের বেলায় মানবতা নিরব কেনো? নাকি বিশ্ব সভ্যতার ঠিকাদার কর্তৃক অসভ্যতা চললে সেটাকে অসভ্যতা বলতে হয় না! কী জানি! তাদেরই তৈরি সাদ্দাম হোসেন যতদিন তাদের ফরমাবরদারী করেছিলেন, ঠিক ছিলেন। যখনই বেঁকে বসেছিলেন তিনি, ঝাপিয়ে পড়া হয়েছিলো ইরাকে। আর এই সময় এক লক্ষেরও বেশি ইরাকি শিশুকে হত্যা করলো ন্যাটো বাহিনী। কোথায় ছিলো তখন বড় বড় বুলি?

আমেরিকার পদলেহন করলে সাদ্দামই করেছিলো। রুখে দাড়ালে সাদ্দামই দাঁড়িয়েছিলো। এ শিশুরা তো কোনো পাপ করেনি। এ শিশুরা তো অস্ত্র ধরেনি। কেন তবে হত্যা করা হলো এদের?

মালালা আমার বোন। সে সুস্থ হোক। কিন্তু ইরাকের এ শিশুরা কি মালালা থেকে কম? তাহলে কেনো তাদের বেঁচে থাকার অধিকার থাকবে না? ডবল স্ট্যান্ডার্ড আর কতদিন চলবে?

পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিকরাষ্ট্র মহাত্মা গান্ধীর ভারতে গেলো চল্লিশ বছরে সাত হাজারের বেশি কাশ্মিরী শিশুকে জীবন দিতে হয়েছে। এ শিশুরা, আফগান, ইরাক আর কাশ্মিরের। এই শিশুরা তো আর সন্ত্রাসবাদী ছিলো না। এরা কোথাও যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়নি। এরা জীবনে কাউকে একটা গুলিও করেনি। তাহলে এদের মেরে ফেলা হলা কেনো? এ শিশুদের অপরাধ কী ছিলো? বিশ্ব মানবতা এদের বেলায় নিরব কেনো?
.
একজন মালালাকে নিয়ে আধিখ্যেতার অন্ত নেই। বিশ্বের অত্যাধুনিক হাসপাতাল গুলোতে চলছে তার চিকিৎসা। অথচ, ইরাকে আফগানে ফিলিস্তিনে আহত মালালাদের দেখবার কেউ নেই!

মালালার পেছনে খরচ হচ্ছে লক্ষ লক্ষ ডলার আর এদিকে তাদেরই আঘাতে রাস্তায় পড়ে কাতরাতে থাকা শিশুরা পয়সার অভাবে ধুকছে মৃত্যু যন্ত্রনায়! কেনো? মানবতার নামে কেনো এ উপহাস?
.
চারঃ
.
মারা গেলেন ড. আফিয়া সিদ্দিকা। নয় নয়টি বছর লাগাতার ধর্ষণ আর নির্যাতনের সাথে সাথে তার শরীরে ক্যান্সারের বীজও পুতে দিয়ে ছিলো সভ্যতার মুখোশপরা মার্কিনী নরপশুরা। শারীরিক আর মানসিক যন্ত্রনার দু:সহ নারকীয় একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি হলো।
.
বুকে কুরআন নিয়ে মাথা উচু করেই বিদায় নিলেন আফিয়া। চলে গেলো বোনটি আমার। আমরা তাকে বাঁচাতে পারলাম না। তার চে’ দু:খজনক হল বাঁচানোর চেষ্টাটা পর্যন্ত করলাম না।
.
কেউ বললাম না ড. আফিয়া যদি অপরাধ কিছু করেই থাকেন, নিরপেক্ষ আদালতে তাঁর বিচার হতে পারে (যদিও জানি না সেটি কোন গ্রহে আছে)। কিন্তু বিশ্বের একমাত্র নিউরো সাইন্টিস ও কোরআনের হাফিজা একটি মেয়েকে এভাবে বছরের পর বছর আটকে রেখে পালাক্রমে ধর্ষণ করা আর নির্যাতন করা তো কোনো সভ্য পৃথিবীতে চলতে পারে না! হায়রে সভ্যতা! হায়রে মানবতা!

আজকাল মানুষে আর পশুতে পার্থক্যটা এতো কমে এসেছে যে, ফারাক করতে কষ্ট হয়।.মালালা বেঁচে উঠছে। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠুক। সে সেরে উঠেছে। বিশ্বের বড় মোড়লরা আছে তার সাথে।

আর ঐ যে ! ইরাকে আফগানে বা ফিলিস্তিনে, যারা ধুকছে, এরা হতভাগা! এদের জন্যে কাঁদবারও কেউ নেই। চিকিৎসা করাবারও কেউ নেই? নিয়তির মতিগতির দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তাদের আর আর কিছু করার নেই!

অবাক পৃথিবীই আমাদের ঠিকানা! মালালা ইউসুফজাইকে ওরা কোলে তুলে নিয়েছে এ বলে যে, মালালা ছিলো নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে সোচ্চার কণ্ঠ। আফিয়াকে ওরা মেরে ফেলেছে তিলে তিলে। কারণ, আফিয়া ছিলেন উচ্চ শিক্ষিতা, নিউরো সাইন্টিস্ট।

তবু ওরা কী চায়, কীভাবে চায়, বিশ্ব বিবেক তবুও বুঝে না। নাকি বুঝেও বুঝে না! তবে একটি ব্যাপার বুঝতে পারছি। আমাকে অনেকগুলো চুড়ি কিনতে হবে বিশ্বের দেড়’শ কোটি মুসলমান নেতৃবৃন্দকে পরিয়ে দেবার জন্য। এ ছাড়া আমার আর কী বা করার আছে!

কুরআনের অনুসারী হয়ে ছিলেন বলে মক্কার মুশরিকরা হযরত সুমাইয়াকে উত্তপ্ত বালুতে শুইয়ে রেখে অকথ্য নির্যাতন করতো। আগেই জানানো হয়েছে আফিয়া ইস্যূতে মিডিয়া নিরব! তাই তাঁর মৃত্যুর ব্যাপারেও পরিষ্কার করে জানানো হচ্ছে না কোনো কিছূ।

ড. আফিয়ার মৃত্যু সংবাদটি সঠিক হলে আর তিনি মারা যেয়ে থাকলে ইতোমধ্যে নিশ্চই সুমাইয়ার হাত ধরে বসে আছেন। তাহলে ভাল আছেন তিনি। কিন্তু বিশ্ব মুসলিম ভালো থাকবে কেমন করে? আর ওপারে যেয়েই বা কী জবাব দেবে? আফিয়া তো চলে গেলেন! বিশ্ব বিবেকের গালে চপেটাঘাত করে।

একজন আফিয়া এভাবে নিষ্পেষিত হয়ে বিদায় নিলো আমাদের চোখের সামনে। কেউ কিছু বললো না! কেউ কিছু করলো না! বুঝতে পারছি না ধিক্কার আমি কাকে দেবো?

– আব্দুল্লাহ আল হাসান

 

তাহাজ্জুদের নামায

বিখ্যাত বুযূর্গ জুনাইদ বাগদাদী রহ.
এর ইন্তিকালের পর জনৈক ব্যক্তি
তাঁকে স্বপ্নে জিজ্ঞেস করলেন– হে
আবুল কাসেম ! (উপনাম) আপনার
কী অবস্থা? এই জগতের কোন জ্ঞান
আপনার বেশি উপকার করেছে?!
উত্তরে তিনি বললেন, সব রকমের
তথ্য ও তত্ত্বজ্ঞান বেকার ও অনর্থক
সাব্যস্ত হয়েছে ! ঐ কয়েক রাকাত
সালাতই শুধু আমার কাজে এসেছে,
যা আমি রাতের নির্জনতায় আদায়
করেছিলাম ৷
[ ইমাম গাযালীর (রহ.) চিঠি থেকে ]

 

বাল্য বিয়ে/বিবাহ

হায়, এদেশে ‘বাল্য বিয়ে’ নামক কথিত অপরাধের (!) জাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে আঠারো হয়নি বলে বাবা-মা আজ তাদের ষোল / সতেরো বছরের মেয়েকেও বিবাহ দিতে পারছেন না নির্বিঘ্নে ! বিয়ে বাড়ীতে উপস্থিত হয়ে যাচ্ছে ‘বন্ধুবেশী’ সাংবাদিকসহ সরকারী ও বিভিন্ন এনজিও আমলারা ! ‘বাল্য বিয়ে’ নামক এই ভয়াবহ অপরাধের (!) কারণে মোটা অংকের জরিমানাও গুণতে হচ্ছে অসহায় বাবা-মা ও বর পক্ষকে! বন্ধুবেশী লোকগুলো ডাকাতের মতো কীভাবে লাঞ্ছিত করলো বর-কনে ও তাদের পরিবারকে! উনারা যে শোভাকাঙ্খী বন্ধু! খুব বেশি দুঃখ লাগে তখন, যখন দেখি- বাল্য বিয়ে নামক (বাস্তবে যা যথোপযুক্ত বিয়ে) বিষয়কে এই ৯২% মুসলমানের দেশে ‘অপরাধ’ হিসেবে চিহ্নিত করে দেখালেও, অপরাধ হিসেবে দেখানো হয়না ‘বাল্য প্রেম/সেক্স’ ও বাল্য পতিতাবৃত্তিকে! প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে নানাভাবে বরং এর উৎসাহ এমনকি প্রশিক্ষণও প্রদান করা হচ্ছে! যার অনেক ‘নিশ্চিত প্রমাণ’ দেওয়া যাবে ৷ একটি বৈধ/নৈতিক ও হালাল পদ্ধতিকে বাঁধাগ্রস্থ করে রেখে একটি অবৈধ/অনৈতিক ও হারাম পদ্ধতির দিকে আমাদের সন্তানদেরকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে কু-পরিকল্পিতভাবেই! যা কোন অবস্থাতেই অন্ততঃ ৯২% মুসলমানের দেশে কাম্য নয় ৷

আমার মতে- নিজ কন্যার প্রতি একজন সত্যিকারের বাবা-মায়ের চেয়ে বেশি দয়াবান, বেশি কল্যাণকামী ও বেশি হিতাকাঙ্খী জগতে আর কেউ হতে পারে না, হওয়া সম্ভব নয় ৷ হলে, নিশ্চিত তার/তাদের মতলব খারাপ ৷ কাজেই, কন্যার স্নেহপরায়ণ বাবা-মা ই জানেন ও বুঝেন, কখন তাদের নয়ণের মণি কন্যাকে বিয়ে দিতে হবে এবং কত বছর বয়সী লোকের সাথে ! এখানে অন্য কারো জঘন্য হস্তক্ষেপ করা আদৌ উচিত নয় ৷

বিয়ে-শাদীর ক্ষেত্রে বঙ্গ আইনে ছেলেদের বয়স কিছুটা যৌক্তিক হলেও মেয়েদের বয়স ১৮ নির্ধারণ করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক মনে করছি ৷ ১৮ না হয়ে ১৫-১৬ হলেও কিছুটা মানার মত যুক্তি রাখে ! আপনার মন চায় তো- ৫০ বছরের বুড়ী বানিয়ে আপনার মেয়েকে বিয়ে দিন না! কে না করেছে আপনাকে?! কিন্তু, আমরা মনে করি- সব মেয়ে নয়, অনেক মেয়ে ১৫ বছর বয়সেই বিয়ের উপযুক্ত হয়ে যায় এবং যেভাবেই হোক (মিডিয়া, সিনেমা, নাটক, বাজে সংস্রব) প্রয়োজনীয় সবকিছু এর মধ্যেই তারা শিখে ফেলে ৷ ব্যতিক্রম মনে হলে বাবা-মা ই সিদ্ধান্ত নিবেন যে, কখন তাদের কন্যাকে তারা বিয়ে দিবেন ৷ যুগের অধঃপতন ও নিরাপত্তার বিষয়গুলোও তারা মাথায় রাখেন ৷ বিষয়টা দায়িত্ত্বশীলদের ‘ইনসাফপূর্ণ’ নজরে আসলে ভালো হতো !

 

হযরত আলীর রা. নসীহত

রাতের আঁধারে এমন কোন
কাজ করো না , যার কারণে
দিনের আলোয় তোমাকে মুখ
লুকিয়ে থাকতে হয় ৷ দিনের
আলোতেও এমন কোন কাজ
করো না , যার কারণে ‘রাতের
ঘুম’ তোমার নষ্ট হয়ে যায় ৷

 

মহাসত্যের সন্ধানে হজরত সালমান ফারসী (রা.)

image

সত্য সন্ধানে যে ক’জন মনীষী পৃথিবীতে অমর এবং উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নিয়ে আজো মানুষের অন্তরকে আন্দোলিত করেন, চিন্তা শক্তিকে ভিন্নমাত্রিকতায় নিয়ে যান, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হযরত সালমান ফারসী (রা.)।

তিনি ছিলেন জামানার প্রচীনতম শতবর্ষজীবী মানুষ। বেঁচে ছিলেন আড়াই শত বছর। কোন কোন ঐতিহাসিক বলেন- তিনি আয়ুস্কাল পেয়েছেন সাড়ে তিন শত বছর। নবীজীর ওফাতের পর পঁচিশ বছর জীবিত ছিলেন এবং মদিনাতেই তিনি ইন্তেকাল করেন।

পনের বছর বয়স থেকে শুরু হয় তাঁর সত্যধর্ম অনুসন্ধান প্রক্রিয়া। তখন তার নাম ছিলো মাহবা। পারস্যের অন্তর্গত ইস্পাহান এলাকাভুক্ত রামহরমুজ অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন তিনি। বাবা ছিলেন সেখানকার বড় জমিদার। তিনি ছিলেন অগ্নিপূজক এবং খুবই ধর্মভীরু। একজন পদস্থ এবং সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও তিনি ধর্মের একটি সাধারণ কাজকেও অবহেলা করতেন না। তার ধর্মানুরাগের জন্যেও লোকে তাকে শ্রদ্ধা করতো।

বাবার একমাত্র পুত্র সন্তান হওয়ায় মাহবাকে তার স্থলাভিসিক্ত করার সব শিক্ষা তিনি দিয়েছিলেন। ছেলেকে কখনো কাছ ছাড়া করতেন না। একদিন বিশেষ কারণ বশতঃ মাহবাকে তার বাবা খামার দেখতে পাঠালেন। পথিমধ্যে তিনি একটি খ্রিস্টানদের উপাসনালয় থেকে কিছু পড়ার শব্দ শুনতে পেয়ে সেখানে ঢুকে দেখলেন তারা ইবাদত-বন্দেগী করছে । আজকের আগে তিনি কখনো বাইরে আসার এবং লোকদের দেখার সুযোগ পাননি। তাদের নামাজ পড়া, বিনম্র ব্যবহার, রীতিনীতি এবং প্রাণখোলা ব্যবহার তাঁর খুবই ভালো লাগলো। তিনি বাবার আদেশ ভুলে সেখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবস্থান করলেন এবং ভাবলেন, তাদের ইবাদত খানায় অন্য মাজহাবের লোক প্রবেশ করলে ইবাদতখানা অপবিত্র হয়ে যাবে এবং অগ্নিদেবতার অভিশাপে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু এখানে সব মানুষের প্রবেশাধিকার রয়েছে। এই নীতিই তো মহান ও শ্রেষ্ঠ। যদি কেউ ধর্ম চর্চা করে পরকালের শান্তি আশা করে, তবে এই ধর্মই শান্তির ধর্ম।

তিনি খ্রিস্টানদের ধর্মমত গ্রহণ করতে চাইলে পাদ্রী বললেন, তাকে জেরুজালেম যেতে হবে। কেননা, এখানকার রাজ আদেশ মতে কোনো অগ্নিউপাসককে খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত করা বে-আইনি এবং দণ্ডনীয়। এই আদেশ অমান্যকারীকে এখানে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়ে থাকে।

মাহবা সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে এলে বাবা বিলম্বের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। মিথ্যা বলার অভ্যাস তার ছিলো না। তাই তিনি বাবাকে সব খুলে বললেন। বাবা প্রথমে বোঝালেন। পরে পায়ে শিকল দিয়ে একটি ঘরে আটকে রাখলেন।

বাবার এই কঠোর ব্যবস্থায় মাহবার মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠলো। প্রতিজ্ঞা করলেন যে, সত্য সন্ধানে যদি এমন বাধাই আসে তবে তিনি বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন সব ত্যাগ করবেন।

বন্ধুদের মাধ্যমে মাহবা পাদ্রীর কাছে সংবাদ পাঠালেন যে, সিরিয়ার কোনো যাত্রী কাফেলার খোঁজ পেলে তাকে যেন জানানো হয়। পাদ্রী শিকল কাটার যন্ত্র বন্ধুদের মাধ্যমে মাহবার কাছে পাঠিয়ে দিলেন এবং সিরিয়া যাওয়ার ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। যেদিন কাফেলা সিরিয়ার দিকে রওনা হবে সেদিন তিনি পায়ের শিকল কেটে কাফেলার সঙ্গে মিলিত হলেন এবং সিরিয়ায় পৌঁছে গেলেন।

সিরিয়ার প্রধান পাদ্রীর কাছে তাদের ধর্ম গ্রহণ এবং তার খেদমতে থেকে ধর্ম শিক্ষার আগ্রহ জানালেন। সে মাহবাকে তার কাছে রেখে দিলো। পাদ্রীটি ছিলো জঘন্য প্রকৃতির। লোকদের দান-খয়রাতের ওয়াজ শুনাতো। লোকেরা তার কাছে দান-খয়রাত এনে দিলে তিনি তিনি তা গরিব মিসকিনকে না দিয়ে নিজেই সব আত্মসাৎ করতো। সে সাত মটকি সোনা রূপা লুকিয়ে রেখেছিলো। এ অবস্থায় তার মৃত্যু হলে মাহবা উপস্থিত ভক্তদের তার অপকর্ম সম্বন্ধে অবহিত করলেন এবং লুকিয়ে রাখা সোনা রূপা দেখিয়ে দিলেন। এ দুস্কার্যের জন্য লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে তার লাশ শূলি কাঠে ঝুলিয়ে পাথরের আঘাতে ছিন্নভিন্ন করলো।

নতুন পাদ্রী নিয়োগ দেয়া হলো। তিনি ছিলেন খুব ভালো লোক। দুনিয়ার লিপ্সাহীন এবং খয়রাতের প্রতি আকৃষ্ট।

তার সঙ্গে মাহবার সম্পর্ক খুব ভালো ছিলো। তার মৃত্যুর সময় মাহবা জিজ্ঞাসা করলেন যে, তাকে কি আদেশ করেন এবং এখন তিনি কার আশ্রয়ে থাকবেন। পাদ্রী বললেন, বর্তমানে খাঁটি ধর্ম কোথাও নেই, সকলই বিকৃত করে ফেলেছে। ইরাকের মোসেল এলাকায় এমন একটি খাঁটি খ্রিস্টধর্মীয় পাদ্রী আছেন, তুমি তার কাছে চলে যাও।

মাহবা বর্ণিত সেই পাদ্রী জিরোমের কাছে গিয়ে সব খুলে বললেন এবং তার কাছে রয়ে গেলেন। জিরোম একজন সত্যিকার আবেদ এবং জাহেদ ছিলেন। কিন্তু তিনি ইলম সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন। দামেশকে থাকাকালে মাহবা তাওরাত, ইঞ্জিল প্রভৃতি আসমানী কিতাব পাঠ করেছিলেন। তাছাড়া ঈশায়ী সাহিত্যে মাহবা বেশ বুৎপত্তি লাভ করেন। বাহেব তার বাছাইয়ের কষ্টিপাথরে টিকে থাকতে পারতো না। একমাত্র এই একটি কারণেই জিরোমের কাছে তার শান্তি মিলছিলো না। শুধু ভাবতে লাগলেন কে তাকে বলে দেবে তার মঞ্জিল কোথায়?

একদিন সায়মানা নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে তার দেখা হয়। তিনি মানভী শাখার এক পাদ্রী। তিনি মাহবার সঙ্গে তার মাজহাব সম্বন্ধে বক্তৃতা করলেন। তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে তার মাজহাবের আদর্শসমূহ শিক্ষা করতে শুরু করলেন। কেননা, তার কাজই ছিলো সত্যের অনুসন্ধান করা।

এসময় জিরোম মারা গেলেন। তার মৃত্যুর আগে মাহবা জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার পরে আমি কার কাছে দীক্ষা গ্রহণ করবো?

তিনি মাহবাকে ইরাকেরই নসীবীন এলাকার এক পাদ্রীর খোঁজ দিলেন। তিনি সেখানে উপস্থিত হয়ে সেই পাদ্রীর কাছে থাকলেন। তার মৃত্যুকালে মাহবাকে তিনি আমুরিয়া নামক স্থানের এক পাদ্রীর খোঁজ দিলেন। সেখানে উপস্থিত হয়ে মাহবা সেই পাদ্রীর কাছে থাকলেন। এখানে সঞ্চয়ের দ্বারা তিনি কিছু পশুপাল সংগ্রহ করেন। পাদ্রীর মৃত্যুর সময় কারো খোঁজ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, বর্তমানে আমার কাছে খাঁটি একটি প্রাণীরও খোঁজ নেই, যার কাছে আশ্রয়ের খোঁজ আমি তোমাকে দেবো। অবশ্য এক নতুন নবীর আবির্ভাব কাল ঘনিয়ে আসছে, যিনি হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর খাঁটি একেশ্বরবাদি আদর্শ নিয়ে আসবেন। আরবে জন্মগ্রহণ করবেন এবং উভয় পাশে কাঁকরময় জমি আর মধ্যস্থলে খেজুর বাগানের আধিক্য_ এমন এক এলাকায় হিজরত করে সেখানে বসবাস করবেন। সে নবীর নিদর্শন এমন হবে যে, তিনি হাদিয়া উপঢৌকন স্বরূপ খাদ্য দিলে তা খাবেন কিন্তু সাদকা-খয়রাতের বস্তু খাবেন না এবং তার কাঁধে মোহরে নবুয়ত থাকবে। যদি তোমার সাধ্যে কুলায় তবে তুমি সে দেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করো।

পাদ্রীর মৃত্যুর পর মাহবা কিছুদিন সেখানে অবস্থান করেন। এখানে আরবের একদল বণিকের সঙ্গে তার সাক্ষাত হয়। তিনি তাদেরকে বললেন, তোমরা আমাকে যদি তোমাদের দেশে নিয়ে যাও তবে আমার পশুপাল তোমাদের দিয়ে দেবো। এতে তারা রাজি হলো এবং মাহবাকে সঙ্গে নিয়ে আসলো। কিন্তু তারা ওয়াদিল কোরা নামক স্থানে পৌঁছে তাকে ক্রীতদাস হিসেবে এক ইহুদীর কাছে বিক্রি করে দিলো। এরপর তিনি একজন থেকে আরেক জনের কাছে বিক্রি হতে থাকলেন। এমনিভাবে তিনি তের বা ততোধিক মনিবের হাত বদল হন।

শেষে মদীনাবাসী এক ইহুদী মাহবাকে ক্রয় করলে তিনি মদীনায় পৌঁছেন। এলাকা দেখে তার বিশ্বাস জন্মে যে, এটাই ঐ স্থান যার কথা পাদ্রী বলেছিলেন।

তখনো হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কা থেকে মদীনায় এসে পৌঁছেন নি। মাহবা অতি যত্নের সঙ্গে তার প্রতীক্ষায় ব্যাকুল থাকতেন। একদিন সে তার মনিবের উপস্থিতিতে খেজুর গাছের উপরে কাজ করছিলেন। হঠাৎ এক লোক এসে তার মনিবকে সংবাদ দিলো যে, কোরা মহল্লায় মক্কা হতে একজন লোক এসেছে। সে নিজেকে নবী বলে দাবি করে।

মাহবা গাছের উপর থেকে কথাগুলো শুনতে পান। তার শরীর শিউরে ওঠে। উত্তেজনায় গাছ থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হন। কোন প্রকারে গাছ থেকে নেমে মনিবকে সংবাদটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে সে মাহবাকে ঘুষি মেরে বললো, তুই কাজে থাক। এ সংবাদে তোর দরকার কি?

মাহবা বিকালে কোরা মহল্লায় উপস্থিত হয়ে কিছু খাদ্যবস্তু হযরতের সামনে পেশ করলেন। হযরত (সা.) সে খাদ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন যে, এগুলো সদকা বা দান। এ কথা শুনে রাসূল (সা.) তা সঙ্গীদের দিয়ে দিলেন, নিজে খেলেন না।

আর একদিন মাহবা কিছু খাবার নিয়ে গেলেন এবং বললেন, আপনি সদকা-খয়রাত গ্রহণ করেন না বলে আমি আজ এগুলো আপনার হাদিয়া স্বরূপ পেশ করছি। হযরত (সা.) সঙ্গীগণসহ তা খেলেন।

মাহবা ভাবলেন, দুইটা নিদর্শন ঠিক হলো। এরপর একদিন হযরত (সা.) বসে ছিলেন। মাহবা তার পিছনে দাঁড়িয়ে পিঠ মোবারক দেখার চেষ্টা করতে লাগলেন। নবীজি তার মনোভাব বুঝতে পেরে কাঁধের কাপড় সরিয়ে ফেললেন। মাহবা তার মোহরে নবুয়ত দেখলেন এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে চুম্বন করে কেঁদে ফেললেন। হযরত (সা.) তার সম্পর্কে জানতে চাইলে মাহবা তার জীবনের দীর্ঘ কাহিনী শোনালেন এবং তখনই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন।

মাহবার নাম রাখা হলো সালমান। তিনি পারস্যের অধিবাসী বলে সাহাবীরা তাকে সালমান ফারসী বলে ডাকেন।

যে মহাসত্য সন্ধানে অশেষ দুঃখ-কষ্ট, ঘাত-প্রতিঘাত, দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা তিনি সহ্য করেছেন, সত্য সন্ধানী অতৃপ্ত আত্মা শত বছরেও যার তৃপ্ত হয়নি সেই অতৃপ্ত আত্মা আজ তৃপ্তিতে পরিপূর্ণ। তখন শুধু হৃদয় ছাপিয়ে একটি শব্দই সমস্ত অস্তিত্বজুড়ে প্রভুত্ব করে যাচ্ছিলো ‘পেয়েছি’।

ক্রীতদাসরূপে ইহুদীর কাছে আবদ্ধ থাকায় স্বাধীনভাবে হযরতের সাহচার্য লাভ সম্ভব হচ্ছিলো না। এমন কি বদর এবং ওহুদ যুদ্ধে তিনি শরিক হতে পারেন নি। তাই হযরত (সা.) বললেন, আপনি বিনিময় আদায়ের শর্তে মুক্তি লাভের চুক্তি করে নিন। সে মতে তার মনিবের সঙ্গে আলাপ করলে সে তার মুক্তির জন্য দুইটি শর্ত আরোপ করলো_ ১। তিন বা পাঁচশত খেজুর গাছের চারা সঞ্চয় করে তা রোপণ করতে হবে এবং ঐসব গাছে ফল না আসা পর্যন্ত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। ২। চল্লিশ উকিয়া অর্থাৎ ৬ সেরের অধিক পরিমাণ স্বর্ণ প্রদান করতে হবে। এই দুই শর্ত পূরণ করলে তিনি মুক্তি লাভ করবেন বলে চুক্তি সম্পাদিত হলো।

মহানবী (সা.) সাহাবীগণকে বললেন, খেজুরের চারা দিয়ে তোমরা সালমানকে সাহায্য কর। সেমতে কেউ পাঁচটা কেউ দশটা করে খেজুরের চারা তাকে দিলেন। তিন- মতান্তরে পাঁচশ খেজুর চারা জমা হলে হযরত (সা.) সালমান (রা.)কে গাছ রোপণ করার জন্য গর্ত তৈরি করতে বললেন।

গর্ত তৈরি হলে হযরত (সা.) সেখানে এসে নিজ হাতে গাছগুলো রোপণ করলেন। শুধু একটি গাছ ওমর (রা.) রোপণ করলেন। আল্লাহর কুদরতে এক বছরেই ঐ গাছগুলোতে ফল ধরলো। ওমর (রা.)-এর লাগানো গাছে এক বছরে ফল না ধরায় হযরত (সা.) তা উঠিয়ে পুনঃরোপণ করলে ঐ বছর তাতে ফল এসে গেলো। এভাবে প্রথম শর্ত পুরণ হলো।

এদিকে ডিমের আকারে একটি স্বর্ণচাকা হযরত (সা.)-এর হস্তগত হলে তিনি তা সালমান (রা.)কে দিয়ে বললেন, এ দিয়ে আপনার মুক্তির শর্ত পূরণ করুন। সালমান (রা.) এ দিয়ে শর্ত পূরণ হবে না জানালে, নবীজি বললেন, আল্লাহ তায়ালা এর দ্বারাই সম্পূর্ণ আদায় করে দেবেন।

বাস্তবিকই শর্ত আদায়ের জন্য যখন ওজন দেয়া হলো তখন তা চলি্লশ উকিয়া পরিমাণ দেখা গেল। এমনিভাবে দুইটি শর্ত পূরণ হলো এবং সালমান (রা.) আজাদ হয়ে গেলেন।

সত্য সাধনায় জয়লাভের নিশ্চয়তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন হযরত সালমান ফারসী (রা.)। আজকের দ্বিধান্বিত, বহুধাবিভক্ত সমাজের মিথ্যার বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সত্যকে ধারণ করতে হবে। সত্য সর্বজনীন, সুন্দর। সত্য মানুষকে দেয় সঠিক পথ। করে মহিমান্বিত। সত্য ঔদার্যের বিমুগ্ধ অমীয় ধারা ধারণ করে। লহুদলের সঙ্গে মিশে এগিয়ে গড়িয়ে ধেয়ে চলে কোনো অমরাবতীর কূলে। তাই সাধনা করতে হবে। সত্য পেলে মনুষ্য জীবন স্বার্থক হবে। মানুষ পাবে বেহেশতী সমাজ। এটাই আল্লাহ চান। সত্য খোঁজ, ধারণ করো এবং এগিয়ে যাও। আল্লাহ বলেছেন, ‘ যারা আমাকে লাভ করার জন্য আমার পথে সাধনা সংগ্রাম চালিয়ে যাবে, আমি তাদের জন্য অবশ্যই আমার পর্যন্ত পৌঁছার (সকল) পথ সুগম করে দেবো। ‘

– ইব্রাহীম খলীল কাসেমী

 

ডাঃ মরিস বুকাইলী কেন মুসলিম হলেন?

image

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট, ফ্রাঁসোয়া
মিত্রা প্রেসিডেন্ট পদে থাকেন
১৯৮১-১৯৯৫ সাল পর্যন্ত।
তিনি তার পদে থাকাকালীন
সময়ে আশির দশকের শেষের
দিকে ফিরাউনের মমিকে
আতিথেয়তার জন্য মিসরের
কাছে অনুরোধ জানালেন। ফ্রান্স
তাতে কিছু প্রত্নতাত্তিক গবেষণা
করতে চাইলো। মিসরের সরকার
তাতে রাজি হলো। কাজেই
কায়রো থেকে ফিরাউনের
যাত্রা হলো প্যারিসে! প্লেনের
সিড়ি থেকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট,
তার মন্ত্রীবর্গ ও ফ্রান্সের সিনিয়র
অফিসারগণ লাইন দিয়ে দাড়ালেন
এবং মাথা নিচু করে ফিরাউনের
মমিকে স্বাগত জানালেন !!
ফিরাউনকে জাঁকালো প্যারেডের
মাধ্যমে রাজকীয়ভাবে বরণ করে
তার মমিকে ফ্রান্সের
প্রত্নতাত্তিক কেন্দ্রের একটা
বিশেষ ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হলো,
যেখানে ফ্রান্সের সবচেয়ে বড় বড়
সার্জনরা আছেন এবং তারা
ফিরাউনের মমিকে অটপ্সি বা
ময়নাতদন্ত করে সেটা স্টাডি
করবেন ও এর গোপনীয়তা উদঘাটন
করবেন। মমির উপর গবেষণার জন্য
প্রধান সার্জন ছিলেন প্রফেসর ডাঃ
মরিস বুকাইলি। থেরাপিস্ট যারা
ছিলেন তারা মমিটাকে পুনর্গঠন
করতে চাচ্ছিলেন, আর ডা. মরিস
বুকাইলি দৃষ্টি দিচ্ছিলেন যে –
কীভাবে এই ফিরাউন মারা গেলো!
পরিশেষে, রাতের শেষের দিকে ফাইনাল
রেজাল্ট যেটা আসলো, তা হচ্ছেঃ-
” তার শরীরে লবণ অবশিষ্ট ছিলো৷ ”
এটা সবচে’ বড় প্রমাণ হয়ে দেখা দেয় যে-
সে (ফিরাউন) নিশ্চিত ডুবে মারা
গিয়েছিলো এবং তার শরীরটা ডুবার
পরপরই সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র [নীল নদ ]
থেকে উপরে তুলে আনা হয়েছিলো,
তারপর লাশটা সংরক্ষণ করার জন্য
দ্রুত মমি করা হয়েছিলো !!
কিন্তু ….
এখানে একটা ঘটনা প্রফেসর ডাঃ
মরিসকে বুকাইলীকে হতবুদ্ধ করে দিল
যে, কীভাবে এই মমি অন্য মমিদের
তুলনায় বিলকুল অরক্ষিত অবস্থায়
থাকলো? অথচ এটা সমুদ্র থেকে
তোলা হয়েছে !? কারণ, কোন বস্তু যদি
আদ্র অবস্থায় থাকে, ব্যাকটেরিয়া ঐ বস্তুকে
দ্রুত ধ্বংস করে দেওয়ার কথা ..
কারণ; আদ্র পরিবেশে ব্যাকটেরিয়া খুব
দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করে থাকে !

ডা. মরিস বুকাইলী ফাইনাল রিপোর্ট
তৈরি করলেন, যাতে তিনি বললেন:-
এটা একটা নতুন আবিস্কার ! সেই
সময় তাকে একজন তার কানের কাছে
ফিসফিসিয়ে বললো: ‘ মুসলিমদের এই
ডুবে যাওয়া মমি সম্পর্কে ঝট করে
আবার বলতে যেও না যেনো ! ‘
কিন্তু তিনি দৃঢ়ভাবে এর সমালোচনা
করলেন এবং এটা আজব ভাবলেন যে,
এরকম একটা বিশাল আবিস্কার, যেটা
আধুনিক বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য
সহায়তা করবে.. সেটা জানানো যাবে
না কেনো ?! কেউ একজন এসে তাকে
বললো:- কুরআনে ফিরাউনের ডুবা ও
তার লাশ সংরক্ষণের ব্যাপারে বলা আছে।
এই ঘটনা শুনে ডা. মরিস বুকাইলি
বিস্মিত হয়ে গেলেন এবং প্রশ্ন
করতে লাগলেন, এটা কীভাবে সম্ভব??!
এই মমি পাওয়া গেলো ১৮৮১ সালে,
আর কুরআন নাজিল হয়েছে আজ থেকে
১৪০০ বছর আগে !! সেকালের আরবেরা
প্রাচীন মিসরীয়দের মমি করার পদ্ধতি তো
জানতোই না, মাত্র কয়েক দশক আগে
আমরা জানলাম !!
ডা. মরিস বুকাইলি সেই রাতে ফিরাউনের লাশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে রইলেন, আর গভীরভাবে
ভাবছিলেন- যেটা তার কলিগ তার কানে ফিশফিশিয়ে
বলে গেলো যে- মুসলিমদের কুরআনে ফিরাউনের
লাশের সংরক্ষণের কথা বলা আছে !!
বাইবেলে ফিরাউন কর্তৃক মুসা পিছু নেয়ার কথা বলা
আছে … কিন্তু, ফিরাউনের লাশের কী হলো,
সেটা সম্পর্কে কিছুই বলা নেই।
তিনি নিজেকেই প্রশ্ন করছিলেন
এটা কি সম্ভব যে- এই মমি যার,
সেই (ফিরাউন)-ই মুসার (আ) পিছু
নিয়েছিল? এটা কি ধারণা করা যায়
যে মুহাম্মদ (স) ১৪০০ বছর আগেই
এটা সম্পর্কে জানতেন?? …

ডা. মরিস বুকাইলি সেই রাতে ঘুমাতে পারলেন না,
তিনি তাওরাত আনালেন এবং সেটা পড়লেন।
তাওরাতে বলা আছে-
” পানি আসলো এবং ফিরাউনের সৈন্য এবং তাদের
যানবাহনগুলোকে ঢেকে দিল, যারা সমুদ্রে ঢুকল তাদের
কেউই বাঁচতে পারল না। ” ডা. মরিস বুকাইলি হতবুদ্ধ
হয়ে গেলেন যে, বাইবেলেও লাশের সংরক্ষণের ব্যাপারে
কিছুই বলা নেই?! তিনি তার লাগেজ বাধলেন এবং সিদ্ধান্ত
নিলেন যে তিনি মুসলিম দেশে যাবেন এবং সেখানে পৌছে
প্রখ্যাত মুসলিম ডাক্তারদের সাক্ষাৎকার নিবেন, যারা
অটোপ্সি বিশেষজ্ঞ। তিনি সেখানে পৌছানোর পর
ফিরাউনের লাশ ডুবার পরে সংরক্ষণের আবিষ্কার
তিনি যেটা পেয়েছেন সেটা নিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে সব বললেন।
এ কথা শুনে একজন বিশেষজ্ঞ (মুসলিম) পবিত্র
কুরআন খুললেন এবং আয়াতটা ডা. মরিস বুকাইলীকে পড়ে শুনালেন, যেখানে সর্বশক্তিমান আল্লাহ
সুবহানাহুওয়া তা’য়ালা বলেনঃ-

“ অতএব আজ বাঁচিয়ে দিচ্ছি আমি
তোমার দেহকে, যাতে তা তোমার পশ্চাদবর্তীদের জন্য নিদর্শন হতে পারে। আর নিঃসন্দেহে বহুলোক আমার
মহাশক্তির প্রতি লক্ষ্য করে না। ”
-[ সুরাঃ ইউনূস, আয়াতঃ ৯২ ]

তিনি এই আয়াতের দ্বারা খুবই প্রভাবিত হয়ে
পড়লেন এবং তিনি তার জোর
গলায় চিৎকার দিয়ে বললেন:- আমি
ইসলামে প্রবেশ করেছি, এবং আমি এই
কুরআনে বিশ্বাসী। [সুবহানাল্লাহ]

ডা. মরিস বুকাইলি ফ্রান্স ফিরে গেলেন
এক ভিন্ন অবস্থায়। ফ্রান্সে ১০ বছর তিনি
আর কোন ডাক্তারি প্র্যাকটিস্ করেন নি,
বরং এই সময়েই- (টানা ১০ বছর ধরে)
তিনি সহীহ আরবী ভাষা শিখেছেন।

তিনি পবিত্র কুরআনে কোন বৈজ্ঞানিক
দ্বিমত আছে কিনা সেটা খুজেছেন;
তারপর তিনি পবিত্র কুরআনের একটি
আয়াতের অর্থ বুঝলেন, যেটাতে বলা আছেঃ-

” এতে মিথ্যার প্রভাব নেই, সামনের
দিক থেকেও নেই এবং পেছন দিক
থেকেও নেই। এটা প্রজ্ঞাময়, প্রশংসিত
আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। ”
[সুরাঃ হা-মীম সাজদাহ, আয়াতঃ ৪২]

খুব সম্ভব ১৯৮৬ সালে ডা. মরিস
বুকাইলি একটা বই লেখেন, যেটা
পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের টনক নাড়িয়ে দেয়।
যেটা বেস্ট সেলার হয়। বইটি প্রায় ৫০
টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে!!
বইটির নামঃ-
“ বাইবেল, কুরআন এবং বিজ্ঞান ”

তিনি থিওরি অফ এভুলুশনকে চ্যালেঞ্জ
করে একটি বই লেখেন, যার নাম দেন-
What is the Origin of Man?

– ইব্রাহীম খলীল কাসেমী

 

আসহাবে উখদূদ ও সেই যুবকের ঘটনা

image

কুরআনের গল্প ৷ বহুকাল পূর্বে একজন রাজা ছিলেন ৷
সেই রাজার ছিল একজন যাদুকর। ঐ যাদুকর বৃদ্ধ হলে একদিন সে রাজাকে বলল, ‘আমি তো বৃদ্ধ হয়ে গেছি। সুতরাং আমার নিকট একটি ছেলে পাঠান, যাকে আমি যাদুবিদ্যা শিক্ষা দিব। বাদশাহ তার নিকট একটি বালককে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি তাকে যাদুবিদ্যা শিক্ষা দিতে লাগলেন। বালকটি যাদুকরের নিকট যে পথ দিয়ে যাতায়াত করত, সে পথে ছিল এক সন্ন্যাসীর আস্তানা। বালকটি তার নিকট বসল এবং তার কথা শুনে মুগ্ধ হল। বালকটি যাদুকরের নিকট যাওয়ার সময় ঐ সন্ন্যাসীর নিকট বসে তাঁর কথা শুনত। ফলে যাদুকরের নিকট পৌঁছতে বালকটির দেরী হত বলে যাদুকর তাকে প্রহার করত। বালকটি সন্ন্যাসীর নিকট এ কথা জানালে তিনি বালককে শিখিয়ে দেন যে, তুমি যদি যাদুকরকে ভয় কর তাহলে বলবে, বাড়ীর লোকজন আমাকে পাঠাতে বিলম্ব করেছে এবং বাড়ীর লোকজনকে ভয় পেলে বলবে, যাদুকরই আমাকে ছুটি দিতে বিলম্ব করেছে।

বালকটি এভাবে যাতায়াত করতে থাকে। একদিন পথে সে দেখল, একটি বৃহদাকার প্রাণী মানুষের চলাচলের পথ রোধ করে বসে আছে। বালকটি ভাবল, আজ পরীক্ষা করে দেখব যে, যাদুকর শ্রেষ্ঠ, না সন্ন্যাসী শ্রেষ্ঠ? অতঃপর সে একটি প্রস্তর খণ্ড নিয়ে বলল, ‘হে আল্লাহ! যাদুকরের কার্যকলাপ অপেক্ষা সন্ন্যাসীর কার্যকলাপ যদি তোমার নিকট অধিকতর প্রিয় হয়, তবে এই প্রাণীটিকে এই প্রস্তরাঘাতে মেরে ফেল। যেন লোকজন যাতায়াত করতে পারে’। এই বলে প্রাণীটিকে লক্ষ্য করে সে প্রস্তর খণ্ডটি ছুঁড়ে মারল। প্রাণীটি ঐ প্রস্তরাঘাতে মারা গেল এবং লোক চলাচল শুরু হ’ল।

এরপর বালকটি সন্ন্যাসীর নিকট গিয়ে তাকে ঘটনাটি জানালে তিনি তাকে বললেন, ‘বৎস! তুমি এখনই আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠেছ। তোমার প্রকৃত স্বরূপ আমি বুঝতে পারছি। শীঘ্রই তোমাকে পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। যদি তুমি পরীক্ষার সম্মুখীন হও তাহলে যেন আমার কথা প্রকাশ করে দিও না’। বালকটির দোআয় জন্মান্ধ ব্যক্তি চক্ষুষ্মান হতে লাগল, কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তি নিরাময় হতে লাগল এবং লোকজন অন্যান্য রোগ হতেও আরোগ্য লাভ করতে লাগল।

এদিকে রাজার একজন সহচর অন্ধ হয়েছিল। সে বহু উপঢৌকনসহ বালকটির নিকট গিয়ে বলল, ‘তুমি যদি আমাকে চক্ষুষ্মান করে দাও, তাহলে এ সবই তোমার’। বালকটি বলল, ‘আমিতো কাউকে আরোগ্য করতে পারি না । বরং রোগ ভাল করেন আল্লাহ। অতএব আপনি যদি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনেন, তাহলে আমি আপনার রোগ মুক্তির জন্য আল্লাহর নিকটে দো‘আ করতে পারি। তাতে তিনি হয়ত আপনাকে আরোগ্য দান করতে পারেন’। ফলে লোকটি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনল। আল্লাহ তাকে আরোগ্য দান করলেন।

পূর্বের ন্যায় তিনি রাজার নিকটে গিয়ে বসলে রাজা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে তোমাকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিল’? সে বলল, ‘আমার রব’। রাজা বললেন, আমি ছাড়া তোমার রব আছে কি’? সে বলল, ‘আমার ও আপনার উভয়ের রব আল্লাহ’। এতে রাজা তাকে ধরে তার উপর নির্যাতন চালাতে থাকে। অবশেষে সে বালকটির নাম প্রকাশ করে দিল।

অতঃপর বালকটিকে রাজদরবারে আনা হল। রাজা তাকে বললেন, ‘বৎস! আমি জানতে পারলাম যে, তুমি তোমার যাদুর গুণে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্ত লোকদের রোগ নিরাময় করছ এবং অন্যান্য কঠিন রোগও নিরাময় করে চলেছ। বালকটি বলল, আমি কাউকে রোগ মুক্ত করি না। রোগ মুক্ত করেন আল্লাহ’। তখন রাজা তাকে পাকড়াও করে তার উপর উৎপীড়ন চালাতে থাকেন। এক পর্যায়ে সে সন্ন্যাসীর কথা প্রকাশ করে দিল। তখন সন্ন্যাসীকে ধরে আনা হল এবং তাঁকে বলা হল, তুমি তোমার ধর্ম পরিত্যাগ কর। কিন্তু সে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করল। তখন রাজার আদেশওমে করাত নিয়ে আসা হলে তিনি তা তার মাথার মাঝখানে বসালেন এবং তাঁর মাথা ও শরীর চিরে দ্বিখণ্ডিত করে ফেললেন। তারপর রাজার সহচরকে আনা হল এবং তাকেও তার ধর্ম ত্যাগ করতে বলা হ’ল। কিন্তু সেও অস্বীকৃতি জানালে তাকেও করাত দিয়ে চিরে দ্বিখণ্ডিত করা হল।

তারপর বালকটিকে হাযির করে তার ধর্ম পরিত্যাগ করতে বলা হল। বালকটিও নিজ ধর্ম পরিত্যাগ করতে অস্বীকার করল। তখন রাজা তাকে তার লোকজনের নিকট দিয়ে বললেন, ‘তোমরা একে অমুক পাহাড়ে নিয়ে যাও এবং তাকে সঙ্গে করে পাহাড়ে আরোহণ করতে থাক। যখন তোমরা পাহাড়ের উচ্চশৃঙ্গে পৌঁছবে, তখন তাকে তার ধর্ম পরিত্যাগ করতে বলবে। সে যদি অস্বীকার করে, তাহলে তোমরা তাকে সেখান থেকে নীচে ছুঁড়ে ফেলে দিবে’। তারা বালকটিকে নিয়ে পাহাড়ের উপরে উঠলে বালকটি দোআ করল, ‘হে আল্লাহ! তোমার যেভাবে ইচ্ছা হয়, সেভাবে তুমি আমাকে এদের কাছ থেকে রক্ষা কর’। তৎক্ষণাৎ পাহাড়টি কম্পিত হয়ে উঠল এবং তারা নীচে পড়ে মারা গেল। আর বালকটি (সুস্থ দেহে) রাজার নিকট এসে উপস্থিত হ’ল। রাজা তখন তাকে বললেন, ‘তোমার সঙ্গীদের কি হল’? তখন সে বলল, আল্লাহই আমাকে তাদের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন।

তারপর রাজা তাকে তার একদল লোকের নিকট সোপর্দ করে আদেশ দিলেন, ‘একে একটি বড় নৌকায় উঠিয়ে নদীর মাঝখানে নিয়ে যাও। যদি সে নিজ ধর্ম পরিত্যাগ করে, তো ভাল। নচেৎ তাকে নদীতে নিক্ষেপ কর’। তারা বালকটিকে নিয়ে মাঝ নদীতে পৌঁছলে বালকটি পূর্বের ন্যায় দোআ করল, ‘হে আল্লাহ! তোমার যেভাবে ইচ্ছা হয়, সেভাবে তুমি আমাকে এদের হাত থেকে রক্ষা কর’। এতে নৌকা ভীষণভাবে কাত হয়ে পড়ল। ফলে রাজার লোকজন নদীতে ডুবে মারা গেল। আর বালকটি (সুস্থ দেহে) রাজার নিকটে আসলে রাজা তাকে বললেন, তোমার সঙ্গীদের কি অবস্থা? সে বলল, আল্লাহই আমাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। এরপর সে রাজাকে বলল, ‘আপনি যতই চেষ্টা করুন না কেন আমাকে কোনভাবেই হত্যা করতে পারবেন না। যতক্ষণ না আমি যা বলব, আপনি তা করবেন। রাজা বললেন, ‘সেটা কি’? বালকটি বলল, ‘আপনি একটি বিস্তী র্ণ মাঠে সকল লোককে হাযির করুন এবং সেই মাঠে খেজুরের একটি গুঁড়ি পুঁতে তার উপরিভাগে আমাকে বেঁধে রাখুন। তারপর আমার তূনীর হতে একটি তীর নিয়ে ধনুকে সংযোজিত করুন। তারপর “বালকটির রব আল্লাহর নামে” বলে আমার দিকে তীরটি নিক্ষেপ করুন। আপনি যদি এ পন্থা অবলম্বন করেন, তবেই আমাকে হত্যা করতে পারবেন’।

বালকের কথামত এক বিস্তী র্ণ মাঠে রাজা সকল লোককে সমবেত করলেন এবং বালকটিকে একটি খেজুর গাছের গুঁড়ির উপরে বাঁধলেন। তারপর রাজা বালকটির তূনীর হতে একটি তীর নিয়ে ধনুকের মধ্যভাগে সংযোজিত করলেন। তারপর “বালকটির রব আল্লাহর নামে” বলে বালকটির দিকে তীর নিক্ষেপ করলেন। তীরটি বালকের চোখ ও কানের মধ্যভাগে বিদ্ধ হল। বালকটি এক হাতে তীরবিদ্ধ স্থানটি চেপে ধরল। অতঃপর সে মারা গেল। এ দৃশ্য দেখে উপস্থিত জনগণ বলে উঠল, ‘আমরা বালকটির রবের প্রতি ঈমান আনলাম। আমরা বালকটির রবের প্রতি ঈমান আনলাম। আমরা বালকটির রবের প্রতি ঈমান আনলাম’।

তারপর রাজার লোকজন তাঁর নিকট গিয়ে বলল, ‘আপনি যা আশঙ্কা করছিলেন তাই শেষ পর্যন্ত ঘটে গেল। সব লোক বালকটির রবের প্রতি ঈমান আনল’। তখন রাজা রাস্তা গুলির চৌমাথায় প্রকাণ্ড গর্ত খনন করার নির্দেশ দিলেন। তার কথা মতো গর্ত খনন করে তাতে আগুন প্রজ্জ্বলিত করা হল। তারপর রাজা হুকুম দিলেন, ‘যে ব্যক্তি বালকের ধর্ম পরিত্যাগ করবে না, তাকে ঐ আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মার। অথবা তাকে বলবে, তুমি এই আগুনে ঝাঁপ দাও। রাজার লোকেরা তার হুকুম পালন করতে লাগল। ইতিমধ্যে একজন রমণীকে তার শিশুসন্তানসহ উপস্থিত করা হল। রমণীটি আগুনে ঝাঁপ দিতে ইতস্ততঃ করতে থাকলে শিশুটি বলে উঠল, ‘মা ছবর অবলম্বন (করতঃ আগুনে প্রবেশ) করুন। কেননা আপনি হক পথে আছেন’।

পবিত্র কুরআনের সূরা বুরূজে এ ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, ‘অভিশপ্ত হয়েছে গর্ত ওয়ালারা অর্থাৎ, অনেক ইন্ধনের অগ্নিসংযোগকারীরা; যখন তারা তার কিনারায় বসেছিল। এবং তারা বিশ্বাসীদের সাথে যা করেছিল, তা নিরীক্ষণ করছিল। তারা তাদেরকে শাস্তি দিয়েছিল শুধু এ কারণে যে, তারা প্রশংসিত, পরাক্রান্ত আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল । (বুরূজ ৪-৮)।

[সহীহ মুসলিম হা/৩০০৫ ‘যুহদ ও রিক্বাক্ব’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৭, ছুহাইব বিন সিনান আর-রূমী (রাঃ) হতে বর্ণিত, আহমাদ হা/২৩৯৭৬]।

শিক্ষা :
১. প্রত্যেকটি আদম সন্তান স্বভাবধর্ম ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করে।
২. মুমিন বান্দা সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করবে ও কায়মনোবাক্যে তাঁর নিকট দোআ করবে।
৩. রোগমুক্তির মালিক একমাত্র আল্লাহ; কোন পীর-ফকীর বা সাধু-সন্ন্যাসী নয়।
৪. আল্লাহর পথের নির্ভীক সৈনিকেরা বাতিলের সামনে কখনো মাথা নত করে না।
৫. মুমিন দুনিয়াবী জীবনে পদে পদে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তার ঈমানের মযবূতী পরখ করেন।
৬. হক্বের বিজয় অবশ্যম্ভাবী ৷

– ইব্রাহীম খলীল কাসেমী

 

আসহাবে কাহফের ঐতিহাসিক ঘটনা

image

ভূমিকা :

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তায়ালা যে সমস্ত ঘটনা উল্লেখ করেছেন, তার প্রত্যেকটি ঘটনাতেই আমাদের জন্য অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। কিন্তু আমাদের অনেকেই সেই ঘটনাগুলো এমনভাবে উপস্থাপন করেন, যাতে শিক্ষণীয় বস্তুগুলো সুস্পষ্ট হয়ে উঠে না। বক্তাগণ এ সমস্ত ঘটনা বলে শ্রোতাদেরকে কখনও হাসান আবার কখনও কাঁদান ঠিকই, কিন্তু যেই উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ্ ঘটনাগুলো উল্লেখ করেছেন, সেই সুমহান উদ্দেশ্যগুলো অনেক ক্ষেত্রে অস্পষ্টই থেকে যায়। কুরআনে বর্ণিত আসহাফে কাহাফ বা গুহাবাসীর আশ্চর্যজনক ঘটনাও কুরআনের শিক্ষণীয় ঘটনাসমূহের অন্যতম একটি ঘটনা। আসুন আমরা তাফসীরে ইবনে কাছীর ও কাসাসুল কুরআনের আলোকে এই শিক্ষণীয় ঘটনা এবং তার শিক্ষণীয় বিষয়গুলো জেনে নিই।

ঘটনা :

সেই যুগে কোন এক ঈদের দিন জনগণ মূর্তি পূজার অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে বের হল। এতে তারা তাদের মূর্তিগুলোর নৈকট্য লাভের জন্য পশু যবাই বা অন্যান্য যা যা করার তাই করবে। কিন্তু তাদের সম্ভ্রান্ত ও সম্মানিত বংশের একজন যুবক মূর্তি পূজার এই মহড়া কোন ক্রমেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তারা যে সমস্ত কল্পিত মাবুদের উপাসনা করছিল, তা দেখে তিনি বিবেকের কাছে থমকে দাঁড়ালেন। সন্দেহ তাঁর মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। তাঁর চিন্তা ও চেতনায় এক নতুন গতির সঞ্চার হল। তিনি জন সমাবেশ ত্যাগ করে চুপ করে বের হয়ে গেলেন। একটি গাছের নীচে গিয়ে পেরেশান হয়ে বসে রইলেন।

কিছুক্ষণ পর তার মতই আরেকজন যুবক এসে তার সাথে বসে পড়লেন। তার মনেও একই সন্দেহ। এক এক করে সাতজন যুবক এসে একত্রিত হলেন। সকলের মনে প্রশ্ন একটাই। নিজ হাতে গড়া কাঠের ও পাথরের মূর্তি কি করে আমাদের মাবুদ হতে পারে? কল্যাণ-অকল্যাণের ক্ষমতাই বা কোথায় পেল তারা? যিনি এই সুন্দর পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, এই আকাশ-বাতাস তৈরী করেছেন, যিনি আমাদের জীবন ও মরণের একমাত্র মালিক, তাঁকে বাদ দিয়ে এগুলোর এবাদত কি করে সম্ভব? এই সাতজনের মধ্যে কোন প্রকার রক্তের সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ঈমানের বন্ধনে তাদের একজন অন্যজনের সাথে আটকে গেলেন। তারা সকলেই এক বাক্যে পরস্পরের নিকট জাতির লোকদের মূর্তি পূজা ও শির্কের প্রতি মনের সন্দেহের কথা প্রকাশ করলেন। অতঃপর তারা মহা বিশ্বের মাঝে তাদের প্রখর দৃষ্টি ঘুরালেন। এতে তাদের অন্তরসমূহ তাওহীদের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল এবং আল্লাহর মনোনিত দ্বীনের সন্ধান পেয়ে তাদের আত্মা এক অনাবিল প্রশান্তি লাভ করল। তারা সকলেই ঈমান গোপন রাখার উপর একমত হলেন। কারণ তাদের বাদশাহ ছিল মূর্তি পূজক, মুশরিক যে তার প্রজাদেরকে শিরক করতে বাধ্য করত।
তারা সমাজের অন্যান্য লোকদের সাথেই বাস করতে থাকলেন। কিন্তু তাদের প্রত্যেকেই যখন একাকী হন তখন আল্লাহর এবাদতের দিকে মনোনিবেশ করেন। কোন এক রাতে তারা যখন একত্রিত হলেন, তখন তাদের একজন নীচু আওয়াজে এবং পূর্ণ সতর্কতার সাথে বললেনঃ হে আমার বন্ধুগণ! গতকাল আমি একটি খবর শুনেছি। এটি যদি সত্য হয়, (আমার ধারণাও তাই) তাহলে অচিরেই আমাদেরকে আমাদের দ্বীন হতে ফিরিয়ে রাখা হতে পারে অথবা আমাদের জীবন নাশ করা হতে পারে। আমি শুনলামঃ আমাদের ব্যাপারটি এখন আর বাদশাহর কাছে গোপন নয়, আমাদের দ্বীন ও আকীদাহর বিষয়টি এখন তার কাছে অস্পষ্ট নয়। যেই দ্বীনকে আমরা হৃদয়ে গেঁথে নিয়েছি এবং যা আমাদের চিন্তা-চেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে, তা এখন বিপন্ন হওয়ার পথে। সুতরাং তোমরা চিন্তা কর এবং তোমাদের সিদ্বান্ত তোমরাই গ্রহণ কর।

দ্বিতীয়জন বললেনঃ খবরটি আমিও শুনেছি। তবে তা মুনাফেক এবং অজ্ঞদের অপপ্রচার মনে করে উড়িয়ে দিয়েছি। পরক্ষণেই খবরটির সত্যতা প্রমাণিত হল। তারা বললেনঃ আমরা আমাদের দ্বীনের উপর অবিচল থাকবো। যে বিপদই আসুক না কেন, তা মাথা পেতে মেনে নিবো। আল্লাহর সত্য দ্বীনকে জানার পর কোনভাবেই পূর্বের সেই মূর্তি পূজার দিকে ফেরত যাবো না।
গুজব এখন সত্যে পরিণত হল। বাদশাহ তাদের খবরটি জেনে ফেলল। তাদেরকে ঘর থেকে বের করে বাদশাহর দরবারে হাজির করা হল। বাদশাহ বললঃ তোমরা তোমাদের ব্যাপারটি গোপন রাখতে চেষ্টা করেছ। কিন্তু সফল হতে পার নি। আমি জানতে পেরেছি যে, তোমরা বাদশাহ এবং তার প্রজাদের ধর্ম ত্যাগ করেছ। তোমরা এমন এক নতুন ধর্মে প্রবেশ করেছ, যে সম্পর্কে আমি জানি না। কোথা থেকে তা তোমাদের আসল? আমি তোমাদেরকে কখনই এভাবে ছেড়ে দিবো না। আমি জানি তোমরা সম্ভ্রান্ত বংশের লোক। তাই অন্যরা তোমাদের কারণে বিভ্রান্ত হতে পারে। এমন আশঙ্কা যদি না থাকত তাহলে তোমাদেরকে বাঁধা প্রদান করতাম না।

যাই হোক, আমি তোমাদের ব্যাপারে তাড়াহুড়া করতে চাচ্ছি না। তোমরা চিন্তা কর। হয় তোমরা আমার ধর্মে ফেরত আসবে অন্যথায় তোমাদের মাথাগুলো দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে।
কিন্তু তাদের অন্তরগুলোকে আল্লাহ মজবুত করে দিলেন। ঈমানকে শক্তিশালী করে দিলেন। তারা বললেনঃ হে বাদশাহ! আমরা এই দ্বীনে কারও অন্ধ অনুসরণ করে প্রবেশ করি নি, বাধ্য হয়েও নয় এবং অজ্ঞাত বশত:ও নয়। আমাদের সুস্থ বিবেক ও ফিতরাত আমাদেরকে ডাক দিয়েছে। আমরা সেই ডাকে সাড়া দিয়েছি। বিবেক আমাদেরকে আলোকিত করেছে। তার আলোতেই আমরা চলছি। আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তার কোন শরীক নেই। আমরা তাঁকে ছাড়া আর কাউকেই ডাকবো না। আর আমাদের জাতির লোকেরা অন্ধ হয়ে অন্যের তাকলীদ করে মূর্তি পূজা করছে, যে ব্যাপারে তাদের কাছে কোন দলীল-প্রমাণ নেই। এই হল আমাদের শেষ কথা। এখন আপনার যা খুশী করতে পারেন।

এরপর বাদশাহ বললঃ এবার যাও। আগামীকাল অবশ্যই আসবে। আমি তোমাদের ব্যাপারে ফয়সালা প্রদান করবো। তারা ফিরে এসে পরামর্শ করতে লাগলেন এবং প্রত্যেকেই স্বীয় মতের চাকা ঘুরাতে লাগলেন। তাদের একজন বললেনঃ বাদশাহ যেহেতু আমাদের ব্যাপারটি জেনেই ফেলেছে, তাই তার ধমকি ও হুমকির মধ্যে থেকে আমাদের কোন লাভ নেই। আমরা ঐ গুহার দিকে দ্বীন নিয়ে পালিয়ে যাবো। যদিও তা হবে এই প্রশস্ত দেশের তুলনায় খুব অন্ধকার ও সংকীর্ণ। কিন্তু আমরা সেখানে প্রশস্ত মনে এক আল্লাহর এবাদত করতে পারবো, যা আমরা এই বিশাল রাজ্যে করতে করতে পারছি না। এমন দেশে আমাদের বসবাস করাতে কোন কল্যাণ নেই, যেখানে আমরা নিরাপদে আমাদের আকীদাহ-বিশ্বাস অনুযায়ী দ্বীন পালন করতে পারি না এবং এমন দেশে আমাদের বসবাস করা ঠিক হবে না, যেখানে আমাদের সঠিক বিশ্বাসের বিরুদ্ধে অন্য একটি বাতিল মত চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।
সুতরাং সকলেই এই কথায় একমত হয়ে গেলেন। তারা সফর সামগ্রী তৈরী করে নিজ দেশ ছেড়ে এক অজানা পথের উদ্দেশ্যে দ্বীন নিয়ে হিজরত শুরু করলেন। পথে একটি কুকুর তাদের সাথী হয়ে গেল, একই পথে চলতে লাগল, তাদের সাথে ভালবাসার বন্ধনে আটকে গেল এবং তাদের প্রহরী হওয়ার দায়িত্ব পালনে নিজেকে নিজেই মনোনিত করল। ভালকে ভালবাসলে এবং সৎ লোকের সাহচর্যে গেলে আল্লাহর প্রিয় হওয়া যায়, এই প্রাণীটি হয়তবা তা অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিল। পথ চলতে চলতে এক সময় তারা গুহায় পৌছে গেলেন। হয়তবা সেখানে তারা আল্লাহর দেয়া রিজিক থেকে ফল-ফলাদি পেয়ে গেলেন এবং ঝর্ণার পরিচ্ছন্ন মিষ্টি পানি পান করলেন। দীর্ঘ পথ চলার পর সফরের ক্লান্তি দূর করার জন্য পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে সেখানে তারা সামান্য বিশ্রামের নিয়তে গুহার মধ্যকার যমীনে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন। শুয়ে পড়ার সাথে সাথেই হালকা ঘুম অনুভব করলেন এবং সেই হালকা ঘুমের পথ ধরেই গভীর নিদ্রা চলে আসল।
পরের দিন নির্দিষ্ট সময়ে বাদশাহর দরবারে হাজির না হওয়াতে তার লোকেরা তাদের অনুসন্ধানে বের হল। এমন কি তারা সেই গুহার দরজা পর্যন্ত পৌঁছে গেল। কিন্তু হিজরতের পথে মক্কার মুশরিকরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আবু বকর (রাঃ)এর সন্ধানে বের হয়ে গারে ছাওর পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েও যেভাবে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল আল্লাহ তায়ালা সেভাবেই তাদেরকে অন্ধ করে দিলেন।

এখানে ঘটে গেল আল্লাহ তায়ালার এক বিষ্ময়কর ঘটনা।

দিনের পর আসে রাত। রাতের পর দিন। পার হয়ে গেল বছরের পর বছর। যুবকগণ শুয়ে আছেন। গভীর নিদ্রা তাদেরকে আচ্ছন্ন করে আছে। বাইরের কর্ম ব্যস্ত জীবনের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই, আকাশে বিজলীর গর্জন, বাতাসের প্রচন্ডতা এবং পৃথিবীর কোন ঘটনাই তাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে নি। সূর্য উদিত হওয়ার সময় ডান পাশে হেলে গিয়ে গুহার ছিদ্র দিয়ে সামান্য আলো প্রবেশ করে এবং আল্লাহর হুকুমে তাদেরকে সামান্য আলো ও তাপ প্রদান করে। কিন্তু সূর্যের প্রখর উত্তাপ তাতে প্রবেশ করে না। আল্লাহর ইচ্ছায় তাদের শরীরকে হেফাজতের জন্য অস্ত যাওয়ার সময়ও সূর্য একটু বাম দিকে হেলে যায়। কুকুরটি তার দুই বাহু প্রসারিত করে বীরের মত প্রহরীর কাজে গুহার বাইরে অবস্থানরত।
তারা সেখানে মাঝে মাঝে ডানে বামে পার্শ্ব পরিবর্তন করছেন। কে আছে এমন যে এই দৃশ্য দেখে ভয় পাবে না?
গভীর নিদ্রায় তিনশ নয় বছর পার হয়ে গেল।এবার তারা ক্ষুধা ও পিপাসায় দুর্বল শরীর নিয়ে জাগ্রত হলেন। তারা ভাবলেন সময় বেশী অতিক্রম হয় নি এবং ইতিহাসের চাকা গুহার মুখেই থমকে রয়েছে। তাদের একজন বললেনঃ হে বন্ধগণ! আমার মনে হয় এখানে আমরা দীর্ঘ সময় ঘুমিয়ে পার করেছি। তোমাদের মতামত কি?
অন্যজন বললেনঃ আমার মনে হয় পূর্ণ একদিন আমরা নিদ্রিত ছিলাম। কারণ যে ধরণের ক্ষুধা ও পিপাসা আমরা অনুভব করছি, তাতে তাই মনে হয়।
তৃতীয়জন বললেনঃ সকালে ঘুমিয়েছি। এই দেখো সূর্য এখনও ডুবে যায় নি। আমার মনে হয় একটি দিবসের কিয়দাংশই আমরা নিদ্রায় অতিক্রম করেছি।
চতুর্থজন বললেনঃ ছাড়ো এ সব মতভেদ। আল্লাহই ভাল জানেন, আমরা কতকাল এখানে ঘুমিয়েছি। মূল কথা হচ্ছে আমার প্রচুর ক্ষুধা অনুভব হচ্ছে। মনে হচ্ছে কয়েক দিন যাবৎ না খেয়ে আছি। আমাদের একজনের উচিত এখনই শহরে গিয়ে কিছু খাদ্য ক্রয় করে নিয়ে আসুক। তবে তাকে অবশ্যই সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ লোকেরা যদি আমাদের অবস্থান সম্পর্কে জেনে ফেলে তবে তারা আমাদেরকে হত্যা করতে পারে কিংবা আমাদেরকে ফিতনায় ফেলে দ্বীন পালন থেকে বিরত রাখতে পারে। তাকে আরেকটি বিষয়ে সাবধান হতে হবে। কোনভাবেই যেন হারাম খাদ্য ক্রয় করা না হয়। সে জন্য সে যাচাই-বাছাই করে হালাল খাদ্যটিই ক্রয় করবে।

তাদের একজন সাবধানতা ও পূর্ণ সতর্কতার সাথে ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় শহরে প্রবেশ করলেন। তিনি দেখলেন কোন কিছুই আর আগের মত নেই। ঘরবাড়িগুলো পরিবর্তন হয়ে গেছে। পুরাতন পরিত্যাক্ত ঘরের স্থলে বিশাল প্রাসাদ শোভা পাচ্ছে। আগের রাজপ্রাসাগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। তিনি এখন যে সমস্ত চেহারা দেখছেন সেগুলো পরিচিত কোন লোকের চেহারা নয়। নদীর স্রোত আগের মতই চলছে বয়ে, পরিবর্তিত রূপ ধারণ করে ঘরবাড়ি ও বন-বনানী ঠিকই আছে। শুধু নেই আগের মানুষগুলো।
তার দৃষ্টি বিচলিত হল, এদিক সেদিক চোখ ঘুরানোতে লোকেরা সন্দেহ পোষণ করতে লাগল এবং তার চলার ভঙ্গিতে মানুষের সন্দেহ দানা বেঁধে উঠল। পরিশেষে লোকেরা তাকে ঘিরে ধরল। উপস্থিত লোকদের একজন তাকে জিজ্ঞেস করলঃ আপনি কি এখানে অন্য দেশ থেকে এসেছেন? এত চিন্তা করছেন কি নিয়ে? অনুসন্ধানই বা করছেন কী?

তিনি বললেনঃ আমি এখানে অপরিচিত কেউ নই। আমি কিছু খাদ্য ক্রয় করতে চাই। কিন্তু কোথায় তা বিক্রি হচ্ছে আমি তা জানি না। একজন লোক তার হাত ধরে খাদ্যের দোকানে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে তিনি রোপার তৈরী কয়েকটি দিরহাম বের করলেন। দোকানের মালিক দিরহামগুলো হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেনঃ এ তো তিনশ বছরের অধিক সময় আগের তৈরী! সে ভাবল এই ব্যক্তি হয়ত কোন গুপ্তধন পেয়েছেন। সম্ভবতঃ এই দিরহামগুলো ছাড়াও তার কাছে বিপুল পরিমাণ দিরহাম রয়েছে। দোকানের মালিক বাজারের লোকদেরকে ডেকে একত্রিত করল।
এবার গুহাবাসী লোকটি বললেনঃ হে লোক সকল! দেখুনঃ আপনার যা ভাবছেন, বিষয়টি আসলে তেমন নয়। এই মূদ্রাগুলো লুকায়িত অসংখ্য সম্পদের কোন অংশ নয়। গতকাল মানুষের সাথে কোন এক লেনদেনের সময় তা আমার হস্তগত হয়েছে। আর এই তো আজ আমি তা দিয়ে কিছু খাদ্য ক্রয় করতে চাচ্ছি। আপনারা তাতে এত আশ্চর্যবোধ করছেন কেন? এর কোন কারণ তো আমি খুঁজে পাচ্ছি না। আর কেনই বা সন্দেহের উপর নির্ভর করে আমার বিরুদ্ধে গুপ্তধন পাওয়ার এবং তা লুকিয়ে রাখার অপবাদ দিচ্ছেন?
এই কথা বলে তাদের ব্যাপারটি মানুষের কাছে প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার ভয়ে তিনি স্থান ত্যাগ করতে চাইলেন। কিন্তু লোকেরা কিছুতেই তাকে ছেড়ে দিতে রাজি হল না। ভিড় ভেঙ্গে দিয়ে কিছু লোক একাকী তার সাথে নম্র ভাষায় কথা বলতে লাগল। কথা-বার্তার এক পর্যায়ে তারা যখন জানতে পারল যে, তিনি হচ্ছেন তিন শত নয় বছর পূর্বে জালেম ও কাফের বাদশাহর পাকড়াও থেকে পলায়নকারী সম্ভ্রান্ত বংশের সাত জন যুবকের একজন তখন তারা আরও আশ্চার্যান্বিত হল। তারা আরও জানতে পারল যে, তারা হলেন ঐ সমস্ত যুবক যাদের অনুসন্ধানে বাদশাহ সকল প্রচেষ্টাই করেছিল, কিন্তু তাদের কোন সন্ধান পাওয়া যায় নি। যুবকটি এবার আরও শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। কারণ এখন লোকেরা তাদের ব্যাপারটি জেনে ফেলেছে। তাই তিনি নিজের ও তাঁর সাথীদের জীবন নাশের ভয়ে পালাতে উদ্যোত হলেন।
লোকদের মধ্যে হতে একজন বললঃ হে ভাই! তুমি ভয় করো না। তুমি যেই জালেম বাদশাহর ভয় করছ, সে তো প্রায় তিনশ বছর আগেই ধ্বংস হয়েছে। এখন যিনি এই রাজ্যের বাদশাহ তিনি আপনিও আপনার সাথীদের মতই একজন মুমিন বান্দা। এবার বলুনঃ আপনার অন্যান্য সাথীগণ কোথায়?
যুবকটি এবার আসল ঘটনা জানতে পারলেন। ইতিহাসের সেই দীর্ঘ দূরত্বও তিনি উপলব্ধি করতে পারলেন, যা তাকে মানব সমাজ থেকে আলাদা করে রেখেছে। তিনি বুঝতে পারলেনঃ এখন তিনি মানুষের মাঝে চলমান একটি ছায়া ব্যতীত আর কিছুই নন। এরপর তিনি লোকদের উদ্দেশ্যে বললেনঃ আমাকে গুহার অভ্যন্তরে বন্ধুদের কাছে যেতে দাও। আমি তাদেরকে আমার ও আপনাদের অবস্থা সম্পর্কে সংবাদ দেব। তারা দীর্ঘক্ষণ যাবৎ আমার অপেক্ষায় আছেন। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, তারা আমার ব্যাপারে চিন্তিত আছেন।
তখনকার বাদশাহও তাদের খবরটি জেনে ফেললেন। তিনি গুহাবাসীদের সাথে সাক্ষাত করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন এবং দ্রুত গুহার দিকে চলে আসলেন। তিনি তাদেরকে উজ্জল চেহারায় জীবিত অবস্থায় দেখতে পেলেন। তাদের সাথে মুসাফাহা ও আলিঙ্গন করলেন। তিনি তাদেরকে রাজপ্রাসাদে আহবান জানালেন এবং তথায় স্থায়ীভাবে বসবাসের আমন্ত্রণ জানালেন।
তারা সাফ জানিয়ে দিলেনঃ নতুনভাবে জীবন যাপনে আমাদের কোন আগ্রহ নেই। আমাদের ঘরবাড়িগুলো বিলীন হয়ে গেছে, পিতা-মাতা ও সন্তান-সন্তদির কেউ জীবিত নেই এবং আমাদের মাঝে এবং স্বাভাবিক জীবন-যাপনের মাঝে দীর্ঘ দিন যাবৎ কোন যোগসূত্রও নেই। সুতরাং এই পার্থিব জীবনের দিকে ফিরে গিয়ে আর লাভ কি?

অতঃপর তারা আল্লাহর নৈকট্য লাভের আবেদন করলেন, তাঁর কাছে ফেরত যাওয়াকেই পছন্দ করলেন এবং তাঁর প্রশস্ত রহমত দ্বারা তাদেরকে ঢেকে নিতে প্রার্থনা করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। দেহ থেকে তাদের প্রাণ চির দিনের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

এই ঘটনা থেকে কতিপয় শিক্ষা:

১) তাওহীদকে মেনে নেওয়া মানুষের ফিতরাতি তথা সৃষ্টিগত স্বভাব। অর্থাৎ কোন মানুষকে যদি তার স্বভাজাত ধর্মের উপর ছেড়ে দেয়া হয় এবং বাইরের কোন গোমরাহ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তাকে বিভ্রান্ত না করে, তাহলে সে আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দিবে, তারই এবাদত করবে এবং তাঁর এবাদতে অন্য কিছুকে শরীক করবে না। যেমনটি হয়েছেলি ঘটনায় বর্ণিত যুবকদের ক্ষেত্রে।

২) পৃথিবীতে তাওহীদ প্রতিষ্ঠায় যুবকদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

৩) মূর্তি পূজা, অলী-আওলীয়াদের পূজা এবং শির্কের পক্ষে কোন দলীল নেই।

৪) প্রয়োজনে সত্য গোপন করা জায়েয আছে। কিন্তু তা সকল সময়ের জন্য নয়।

৫) সাহসের সাথে তাওহীদের বাণী প্রকাশ্যে প্রচার করা জরুরী।

৬) নিজ দেশে দ্বীন পালন করতে গিয়ে ফিতনার ভয় থাকলে দ্বীন নিয়ে পলায়ন করা আবশ্যক।

৭) আসহাবে কাহাফের ঘটনা আল্লাহর বিশেষ একটি বড় নিদর্শন। তবে তার চেয়েও বড় নিদর্শন হচ্ছে, আসমান-যমীন, চন্দ্র-সূর্যের সৃষ্টি এবং দিবা রাত্রির আগমণ ও প্রস্থান।

৮) বিপদাপদে একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করা এবং তাঁর দয়া কামনা করা জরুরী।

৯) কোন মতবাদ, মাজহাব ও আমল গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কারও অন্ধ অনুসরণ না করে দলীল অনুসন্ধান করা জরুরী।

১০) আল্লাহ্ তাআলা তাঁর বান্দাদের খেদমতের জন্য বড় বড় মাখলুককে বাধ্য করেন।

১১) একজন দাঈ প্রয়োজনে সতর্কতা অবলম্বন করবেন। বিশেষ করে যখন তাঁর পিছনে শত্রুরা ষড়যন্ত্র শুরু করে।

১২) সুখে-দুঃখে হালাল রুজী অনুসন্ধান করা জরুরী।

১৩) চিন্তা ও গবেষণা করে কুরআন ও কুরআনে বর্ণিত ঘটনাগুলো অধ্যয়ন করা উচিৎ।

১৪) বিনা প্রয়োজনে মতভেদ করা অর্থহীন। যেমন গুহাবাসীদের নাম, কুকুরটির নাম ও তার রং সম্পর্কে ঘাটাঘাটি করে কোন লাভ নেই।

১৫) ভবিষ্যতে কোন কাজ করতে ইচ্ছা করলে প্রথমে ইনশা-আল্লাহ্ বলতে হবে।

১৬) প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সত্যের উপর অবিচল থাকার গুরুত্ব অপরিসীম।

১৭) আসহাবে কাহাফের স্থান ও কাল কুরআন ও সহীহ হাদীছে উল্লেখ করা হয় নি। সুতরাং তা খুঁজে বেড়ানোতে আমাদের কোন লাভ নেই। ঘটনাটি ঐ প্রকার গায়েবের অন্তর্ভূক্ত, যা আল্লাহ তাআলা তাঁর নবীকে জানিয়েছেন। তবে তার স্থান ও কাল আমরা জানতে পারি নি।

১৮) নবী সাল্লাল্লাহু গায়েবের সকল খবর জানতেন না। যদি জানতেন, তাহলে অহীর অপেক্ষায় না থেকে প্রশ্ন করার সাথে সাথেই তাদেরকে ঘটনাটি বলে দিতেন।

১৯) আসহাবে কাহাফগণ যে গুহায় অবস্থান করেছিলেন তাও গায়েবের অন্তর্ভূক্ত। এর ঠিকানা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। কেউ যদি এর স্থান নির্দিষ্ট করে বলে সে আল্লাহর নামে মিথ্যা রচনাকারীর অন্তর্ভূক্ত হবে।

২০) কারামতে আওলীয়া সত্য। তাতে বিশ্বাস করা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদাহর অন্তর্ভূক্ত।

২১) তাওহীদ ও শির্কের মধ্যে পার্থক্য করার যোগ্যতা অর্জন করা জরুরী। অন্যথায় তাওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা সম্ভব নয়।

২২) তিন শত নয় বছর পর তাদেরকে জীবিত করা এটাই প্রমাণ করে যে মৃত্যুর পর পুনরুত্থান সত্য, কিয়ামত সত্য। এতে কোন সন্দেহ নেই।

২৩) রূহ এবং দেহ উভয়েরই পুনরুত্থান হবে। কেননা আসহাবে কাহাফগণ এভাবেই জীবিত হয়েছিলেন।

২৪) রক্তের সম্পর্কের চেয়ে ঈমানের সম্পর্ক অধিক মজবুত হওয়া আবশ্যক। ঘটনায় বর্ণিত যুবকদের মধ্যে রক্তের কোন সম্পর্ক না থাকলেও ঈমান ও তাওহীদের বন্ধনে তারা আবদ্ধ হয়ে একই পথের পথিক হয়ে যান।

২৫) হেদায়াত আল্লাহর পক্ষ হতে তাঁর বান্দার প্রতি বিরাট একটি নেয়ামত। বান্দার উচিত সর্ব অবস্থায় আল্লাহর কাছে হেদায়াত প্রার্থনা করা।

২৬) ঘরের মধ্যে কুকুর রাখা নিষিদ্ধ। তাই কুকুরটিকে গুহার বাইরে রাখা হয়েছিল।

২৭) ভাল লোকের সঙ্গে থাকলে ভাল হওয়া যায় এবং ভাল হিসেবে পরিচিতি পাওয়া যায়। কুকুরটি তাদের সাথে থাকার কারণে কুরআনে তার সেটির কথা উল্লেখিত হয়েছে। অপর পক্ষে অসৎ লোকের সঙ্গে থাকলে অসৎ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে নিরাপদ নয়।

২৮) কবরের উপর মসজিদ বা গম্বুজ নির্মাণ করা আমাদের শরীয়তে নিষিদ্ধ।

২৯) বাতিল পন্থীরা সন্দেহ এবং অনুমানের অনুসরণ করে থাকে। সঠিক কোন দলীল তাদের হাতে নেই।

৩০) বয়স বৃদ্ধি হলে এবং অভিজ্ঞতা দীর্ঘ হলেই মানুষ জ্ঞানী হয়ে যায় না। এই যুবকগণ বয়সে কম হলেও তারা সত্য উদঘাটনে সক্ষম হয়েছেন। অথচ সেই জাতির মধ্যে অসংখ্য বয়স্ক ও অভিজ্ঞ লোক থাকা সত্ত্বেও সঠিক পথের সন্ধান পায় নি।

৩১) এখান থেকে প্রমাণিত হয় যে সূর্য চলমান; স্থির নয়। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ তুমি সূর্যকে দেখবে, যখন উদিত হয়, তাদের গুহা থেকে পাশ কেটে ডানদিকে চলে যায় এবং যখন অস্ত যায়, তাদের থেকে পাশ কেটে বামদিকে চলে যায়।

৩২) প্রহরী হিসেবে কুকুর প্রতিপালন করা জায়েয আছে।

৩৩) কোন বিষয়ে জ্ঞান না থাকলে তা আল্লাহর দিকে সোপর্দ করে বলতে হবে আল্লাহই ভাল জানেন।

৩৪) আল্লাহ কখনও দ্বীনের দাঈদের ঈমানী শক্তি পরীক্ষা করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে শত্রুদেরকে শক্তিশালী করে দেন। তখন দাঈদের উচিত ধৈর্য ধারণ করা।

৩৫) তারা সংখ্যায় ছিলেন সাত জন। কারণ আল্লাহ তাআলা প্রথম দু’টি সংখ্যার প্রতিবাদ করে তৃতীয়টির ক্ষেত্রে কিছুই বলেন নি। এতে বুঝা গেল শেষ সংখ্যাটিই সঠিক।

৩৬) যে ব্যক্তি ফতোয়া দেয়ার যোগ্য নয়, তার কাছে ফতোয়া চাওয়া ঠিক নয়।

এছাড়াও আরও অসংখ্য শিক্ষণীয় দিক আছে উক্ত ঘটনায়। যা হয়ত একজন দু’জন মানুষের দ্বারা বের করা সম্ভব নয়। তাই আপনাদের নিকট অনুরোধ যদি উক্ত ঘটনা থেকে আপনার নিকট বিশেষ কোন শিক্ষণীয় দিক থাকে তবে তা নিচে মতামতের ঘরে উল্লেখ করে দিবেন। জাযাকুমুল্লাহু খাইরান। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে দ্বীনের উপর অটল ও অবিচল থাকার তওফীক দান করুন, আমীন ৷

– ইব্রাহীম খলীল কাসেমী